ফারাক্কা বাঁধ: ৫০ বছর ধরে ধুঁকে ধুঁকে মরছে পদ্মা

ভারতের ফারাক্কা বাঁধ চালুর পর গত ৫০ বছরে পদ্মা নদীর পানিপ্রবাহ ৮০ শতাংশ কমেছে। এই পরিবর্তন শুধু একটি নদীর মৃত্যু নয়, এটি একটি অঞ্চলিক পরিবেশগত সংকট, যা বাংলাদেশের কৃষি, জীববৈচিত্র্য ও মানুষের জীবনযাত্রাকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
১৯৭৫ সালের ১৬ মে ভারত পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা বাঁধ চালু করে। এরপর একতরফাভাবে গঙ্গার পানি প্রত্যাহার শুরু করে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গড়ে তোলে তেহরি, ফারাক্কা, মাইথোন, হিরাকুডসহ ৩৩টিরও বেশি বাঁধ ও পানি প্রকল্প। আন্তর্জাতিক পানি আইন অনুসারে, গঙ্গা একটি আন্তঃসীমান্ত নদী হওয়ায় এককভাবে এর পানি প্রত্যাহার বেআইনি। কিন্তু ভারত এ বিষয়ে বাংলাদেশকে পরামর্শ না করেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করে আসছে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, গঙ্গা-পদ্মা প্রবাহ কমে যাওয়ায় প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার নৌপথ অচল হয়ে গেছে। কৃষিতে শুষ্ক মৌসুমে সেচসংকট, মিঠাপানির অভাবে মাছের প্রজনন কমে যাওয়া, নদীতীরবর্তী কৃষকদের আয় হ্রাস এবং ভূমির ক্ষয় মারাত্মকভাবে বেড়েছে।
সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রভাব পড়েছে সুন্দরবনে। বিশ্ব ঐতিহ্যের এ বনাঞ্চলে এখন ১৭ শতাংশ এলাকায় লবণাক্ততা ঢুকে পড়েছে। এতে রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ বহু প্রজাতির জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সমস্যার মূল উৎস হলো ‘গ্যারান্টি ক্লজ’বিহীন গঙ্গা চুক্তি। ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের সঙ্গে যে ৩০ বছর মেয়াদি চুক্তি স্বাক্ষর করেন, সেখানে শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশে ন্যূনতম পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা নেই। ফলে ভারত তাদের অভ্যন্তরীণ চাহিদা অনুযায়ী পানি প্রত্যাহার করে নেয়।
বিএনপি ও পানি অধিকার নিয়ে কাজ করা অনেক সংগঠন এ চুক্তিকে দেশের স্বার্থবিরোধী বলে আখ্যা দিয়েছে। ২০২৬ সালে চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে বাংলাদেশকে গ্যারান্টি ক্লজসহ একটি বৈষম্যহীন নতুন চুক্তির জন্য চাপ দিতে হবে বলে মনে করেন কূটনীতিক ও পানিবিশেষজ্ঞরা।
অন্যদিকে, ১৯৭৬ সালে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ‘ফারাক্কা লংমার্চ’ এবং ১৯৭৭ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান জাতিসংঘে বিষয়টি তুললে আন্তর্জাতিক মহলে কিছুটা সাড়া মিলেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে কূটনৈতিক উদ্যোগ দৃশ্যত শিথিল হয়ে পড়ে।
পদ্মা নদী এখন আর ততটা প্রাণবন্ত নয়। বর্ষা ছাড়া প্রায় পুরো বছরই নদীর পাড়জুড়ে দেখা যায় ধু-ধু বালুচর। নৌচলাচল বন্ধ, কৃষিকাজ ব্যাহত, হাজার হাজার জেলে পরিবার পেশা হারিয়ে দারিদ্র্যসীমায় পৌঁছেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু রাজনৈতিক সদিচ্ছা নয়, এখন প্রয়োজন কঠোর কূটনৈতিক উদ্যোগ এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পানির ন্যায্য হিস্যার দাবি তুলে ধরা।
এদিকে ফারাক্কা চালু হওয়ার দুই দশকেরও বেশি সময় পর ১৯৯৬ সালে ভারত-বাংলাদেশ যে গঙ্গা পানি চুক্তি স্বাক্ষর করে, ৩০ বছর মেয়াদি সেই চুক্তির কার্যকাল শেষ হচ্ছে আগামী বছর। চুক্তির নবায়ন নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনা, তবে শঙ্কা বাড়াচ্ছে দুই দেশের কূটনৈতিকে টানাপোড়েনের ইস্যুটি।
পানিসম্পদ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত বলেন, ‘আমরা চাইবো না যেকোনো অবস্থাতে ভারত যতটুকু পানি আসে, সেটুকু দিবে না। সিদ্ধান্তটা কারিগরি নিরীক্ষায় হবে না, সিদ্ধান্ত আইনগত নিরীক্ষায় হবে না, সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক হিসাবেও হবে না। হবে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক রাজনৈতিক সম্পর্কের ভিত্তিতে। যৌথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই প্রবাহটাকে বাড়াতে হবে।’
এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে সম্প্রতি ইইউ ওয়াটার কনভেনশনে অনুস্বাক্ষরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে ভারত এতে স্বাক্ষর না করলে তা কোনো ফল বয়ে আনবে না বলছেন বিশ্লেষকরা।