ঢাকা মঙ্গলবার, ১৩ই মে ২০২৫, ৩০শে বৈশাখ ১৪৩২


‘উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশ্বে চমক সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশ’


২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ২২:৫২

ছবি সংগৃহীত

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘যে বাংলাদেশকে বলা হতো দুর্যোগ, বন্যা-খরা-হাড্ডিসার মানুষের দেশ, তা এখন বিশ্বশান্তি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশ্বে চমক সৃষ্টি করেছে।’

শুক্রবার বাংলাদেশ সময় সকালে জাতিসংঘের ৭৩ তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের পথচলা এখনও শেষ হয়নি। এ পথচলা ততদিন চলবে, যতদিন না আমরা আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা এবং শোষণমুক্ত সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে পারব।’

তিনি বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব যে বাংলাদেশকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিয়েছে, বাংলাদেশ যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে থাকা দশটি দেশের একটি।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের ভূখণ্ডে প্রতিবেশী দেশগুলোর স্বার্থবিরোধী কোনো কার্যক্রম বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আমরা পরিচালিত হতে দেব না। সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় আমাদের জিরো টলারেন্স নীতি অব্যাহত থাকবে। সহিংস উগ্রবাদ, মানবপাচার ও মাদক প্রতিরোধে বাংলাদেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করার নীতি যে বিশেষ সুফল দিয়েছে।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর কার্যক্রমে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা পেশাদারিত্ব, সাহস ও সাফল্যের জন্য প্রশংসিত হয়েছেন। বাংলাদেশ গত ত্রিশ বছরে ৫৪টি শান্তি মিশনে এক লাখ আটান্ন হাজার ৬১০ জন শান্তিরক্ষী পাঠিয়ে বিশ্ব শান্তি রক্ষায় বিশেষ অবদান রেখেছে। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বাংলাদেশের ১৪৫ জন শান্তিরক্ষী জীবন দিয়েছেন।’

জাতিসংঘের কাছে মিয়ানমারের অসহযোগিতার কথাও তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘রোহিঙ্গা সঙ্কটের শান্তিপূর্ণ সমাধানে মিয়ানমার সরকারের নিষ্ক্রিয়তার প্রমাণ দিয়েছে। রোহিঙ্গা সমস্যার উদ্ভব হয়েছে মিয়ানমারে, তাই এর সমাধান সেখানেই হতে হবে। জাতিসংঘের সঙ্গে মিয়ানমারের যে চুক্তি হয়েছে- আমরা তার আশু বাস্তবায়ন ও কার্যকারিতা দেখতে চাই। আমরা দ্রুত রোহিঙ্গা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই। আমরা আশাহত হয়েছি, কেননা আমাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের স্থায়ী ও টেকসই প্রত্যাবাসন শুরু করা সম্ভব হয়নি।’

এ সংকট নিরসন ও শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং গত এক বছরেও প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণও করেন প্রধানমন্ত্রী।

বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মানবেতর জীবনযাপনের চিত্র তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার মধ্যে একাধিক চুক্তি হয়েছে, সে অনুযায়ী বাংলাদেশ সব প্রস্তুতিও নিয়েছে। কিন্তু তারপরও মিয়ানমার যে নানা কৌশলে প্রত্যাবাসন বিলম্বিত করছে। মিয়ানমার মৌখিকভাবে সব সময়ই রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে বলে অঙ্গীকার করলেও বাস্তবে তারা কোনো কার্যকর ভূমিকা নিচ্ছে না। একজন মানুষ হিসেবে রোহিঙ্গাদের দুঃখ-দুর্দশাকে আমরা যেমন অগ্রাহ্য করতে পারি না, তেমনি পারি না নিশ্চুপ থাকতে।’

গতবছর নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে এই সংকট নিরসনের স্থায়ী ও শান্তিপূর্ণ সমাধানে পাঁচ-দফা প্রস্তাব তুলে ধরেছিলেন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘মিয়ানমার প্রতিবেশী দেশ হওয়ায় প্রথম থেকেই তিনি আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে আসছেন। কিন্তু পরিস্থিতির দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন হয়নি। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়নমারের এই নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা পূরণের চেষ্টা করছে। আমরা সাধ্যমত তাদের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, নিরাপত্তা, শিশুদের যত্নের ব্যবস্থা করেছি।’

এই কাজে জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ, ওআইসিসহ বিভিন্ন সংস্থা ও দেশ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন শেখ হাসিনা।


তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গারা যতদিন তাদের দেশে ফেরত যেতে না পারছে, ততদিন তাদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা রেখে নতুন আবাসন নির্মাণের কাজে সরকার হাত দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে এ কাজে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। একইসঙ্গে রোহিঙ্গারা যাতে সেখানে যেতে পারেন তার জন্যও আমি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহযোগিতা চাচ্ছি।’

রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সরকারি বাহিনীর নির্যাতনের প্রসঙ্গ টেনে শেখ হাসিনা বলেন, ‘গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের যে বিবরণ জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, তাতে আমরা হতভম্ব। আমরা আশা করি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের উপর ঘটে যাওয়া অত্যাচার ও অবিচারের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখবে।’

অধিবেশনে ফিলিস্তিন সমস্যার আশু নিষ্পত্তির ওপর গুরুত্ব আরোপ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ভ্রাতৃপ্রতীম ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন আজও অব্যাহত রয়েছে যা আমাদের মর্মাহত করে। মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে তিনটি মৌলিক উপাদান বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে, তা হল - শান্তি, মানবতা ও উন্নয়ন। তাই মানব সমাজের কল্যাণে আমাদের মানবতার পক্ষে সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে ‘

ওআইসির পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের কাউন্সিলের সভাপতি হিসাবে বাংলাদেশ এ সংস্থার মাধ্যমে ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানে কাজ করে যাবে বলে প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।

‘সমস্যা-সঙ্কুল’ পৃথিবীতে সকলের সম্মিলিত স্বার্থ, সমন্বিত দায়িত্ব ও অংশীদারিত্বই মানব সভ্যতাকে রক্ষা করতে পারে বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।

এ সময় জাতিসংঘের ৭৩ বছরের ইতিহাসে চতুর্থ নারী হিসেবে সাধারণ পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ায় মারিয়া ফের্নান্দা এসপিনোসা গার্সেসকেও অভিনন্দন জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘জাতিসংঘের প্রতি আপনার অঙ্গীকার সুরক্ষায় আপনার যে কোনো প্রচেষ্টায় আমার প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে থাকবে অকুণ্ঠ সহযোগিতা।’

বিশ্ব শান্তি, নিরাপত্তা ও টেকসই উন্নয়ন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘সাহসী ও দৃঢ় নেতৃত্বের’ জন্য জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসকেও অভিনন্দন জানান শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে জাতিসংঘ মহাসচিবের অঙ্গীকার সুরক্ষায় বাংলাদেশের অকুন্ঠ সহযোগিতা থাকবে বলেও জানান তিনি।

আরকেএইচ