ঢাকা মঙ্গলবার, ১৬ই সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১লা আশ্বিন ১৪৩২


আবরার হত্যার আসামিরা ক্যাম্পাসে ভয়ংকর রাজত্ব করেছিল


১৪ নভেম্বর ২০১৯ ২৩:৩৭

ছবি সংগৃহীত

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যায় জড়িতরা ক্যাম্পাসে ভয়ের রাজত্ব গড়েছিল। একজনকে মেরে অন্যজনকে শিক্ষা দিতে এবং জুনিয়রদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াতে দীর্ঘদিন ধরে র‌্যাগিংয়ের নামে নির্যাতন চালিয়ে আসছিল তারা। যার আচরণ অপছন্দ হতো, ডেকে এনে নানা নির্যাতন করা হতো তাকেই। আবরারের খুনিরা রাজনৈতিক পরিচয়কে শেল্টার হিসেবে ব্যবহার করে অছাত্রের মতো আচরণ করত। হত্যার মোটিভ কোনো একক কারণ ছিল না। শিবির সন্দেহসহ একাধিক কারণে টার্গেট করা হয়েছিল তাকে। আবরার হত্যাকাণ্ডে দায়ের করা মামলায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তদন্তে উঠে আসে এসব তথ্য। দেশ-বিদেশে চাঞ্চল্য তৈরি করা এ হত্যা মামলায় বুয়েট ছাত্রলীগের বহিস্কৃত সেক্রেটারি মেহেদী হাসান রাসেলসহ ২৫ জনকে আসামি করে গতকাল বুধবার ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের সংশ্নিষ্ট শাখায় চার্জশিট দাখিল করেছে পুলিশ। চার্জশিটে অভিযুক্তদের মধ্যে ১১ জন সরাসরি হত্যা মিশনে অংশ নেয়। বাদবাকিরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হত্যাকাণ্ডে সহায়তা করে। অভিযুক্তদের মধ্যে চারজন পলাতক। গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছে বাকিরা। আসামিদের মধ্যে ১৪ জন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের বিভিন্ন পদে ছিল। অভিযোগপত্রে বুয়েটের সাত শিক্ষক, ১৩ শিক্ষার্থী, পাঁচ কর্মচারীসহ ৩১ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে।
এজাহারের ১৯ আসামি :আবরার হত্যা মামলার চার্জশিটে মামলার এজাহারভুক্ত ১৯ জনের সবাইকে আসামি করা হয়েছে। আসামিরা হলো- বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল (সিই বিভাগ, ১৩তম ব্যাচ), সহসভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদ (১৪তম ব্যাচ, সিই বিভাগ), সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন (কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ১৫তম ব্যাচ), তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৫তম ব্যাচ), সাহিত্য সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনির (ওয়াটার রিসোর্সেস ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৬তম ব্যাচ), ক্রীড়া সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন (মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৫তম ব্যাচ), উপ-সমাজসেবা সম্পাদক ইফতি মোশাররফ সকাল (বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৬তম ব্যাচ), সদস্য মুনতাসির আল জেমি (এমআই বিভাগ), সদস্য মুজাহিদুর রহমান (ইইই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ), সদস্য হোসেন মোহাম্মদ তোহা (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), সদস্য এহতেশামুল রাব্বি তানিম (সিই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), শামীম বিল্লাহ (মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মাজেদুল ইসলাম (এমএমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), আকাশ হোসেন (সিই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ), খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম

হত্যাকাণ্ডের ৩৭ দিনের মাথায় চার্জশিট দাখিল করায় খুশি আবরারের পরিবারও। এর আগে ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যার এক মাস ১৮ দিনের মাথায় চার্জশিট দাখিল করেছিল পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, 'আবরার হত্যা মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে নেওয়া যাবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আবেদন করলে সব আইনি বাধ্যবাধকতা সম্পন্ন করে মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে নেওয়া সম্ভব। তদন্ত শেষ হলে প্রতিবেদন বিজ্ঞ আদালতে জমা দেওয়ার পর দায়িত্ব হবে প্রসিকিউশন টিমের। প্রসিকিউশন টিম রেডি রাখার কথা বলেছিলাম, যাতে প্রতিবেদন পৌঁছার পরই তারা কার্যক্রম শুরু করতে পারেন। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রসিকিশন টিম রেডি।'

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, 'হত্যার বিচার শিগগির শুরু হবে। বিচার করবেন আদালত। তদন্ত সংস্থা পুলিশ বাহিনীর মাধ্যমে নির্ভুল চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। আশা করছি, শিগগির বিচারকাজ শুরু হবে। আবরার হত্যা মামলার যেসব আসামি পালিয়ে আছে, তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।'

মানবাধিকার আইনজীবী অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, 'এ ধরনের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ আর চাই না। আবরারের মতো এমন একজন মেধাবী ছাত্রের এমন করুণ পরিণতি কোনোভাবে কাম্য নয়। ভবিষ্যতে যাতে কেউ এমন ঘটনায় জড়ানোর সাহস না দেখায়. সে জন্য অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত হওয়া জরুরি।'

বুয়েটের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী অন্তরা মাধুরী তিথি বলেন, 'তিনটি দাবিতে একাডেমিক অসহযোগ বলবৎ রয়েছে। তা হলো চার্জশিট দাখিলের পর অভিযুক্তদের স্থায়ীভাবে বহিস্কার। সম্প্রতি তিনটি র‌্যাগিংয়ের ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি দাবি। বুয়েটে রাজনৈতিক ও র‌্যাগিংয়ের সঙ্গে যুক্তদের ব্যাপারে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সে ব্যাপারে বিধিমালা করে অর্ডিন্যান্সে যুক্ত করা। যেহেতু চার্জশিট দাখিল হয়েছে, তাই পরবর্তী করণীয় নিয়ে বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন ডাকা হবে।'

বুয়েটের ছাত্রকল্যাণ পরিচালক মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, অভিযোগপত্রের অনুলিপি পাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। পেলেই তা বুয়েটের অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটিকে দেওয়া হবে। তদন্ত কমিটি তাদের বাকি কাজ সম্পন্ন করে প্রতিবেদন দিলে সঙ্গে সঙ্গে তা বুয়েটের শৃঙ্খলা কমিটিতে তোলা হবে। সেখানেই অভিযুক্ত ছাত্রদের চূড়ান্ত বহিস্কারের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে। দ্রুত সময়ের মধ্যে এসব কাজ শেষ হবে।

গত ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হল থেকে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। পরে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা পিটিয়ে হত্যা করেছে তাকে। আবরার হত্যার ঘটনায় বাদী হয়ে ১৯ জনকে আসামি করে চকবাজার থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন তার বাবা। পরে মামলাটির তদন্ত শুরু করে ডিবি। আবরার হত্যার প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে বুয়েট ক্যাম্পাস। তিনি নিহত হওয়ার পর আন্দোলনে নেমে ১০ দফা দাবি তোলেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে বুয়েট শিক্ষক সমিতি ও সাবেক শিক্ষার্থীরাও সমর্থন প্রকাশ করেন।