এক সড়কেই খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই !

সন্ধ্যা নামতেই সড়ক যেন নরক হয়ে উঠে। খুন, ধর্ষণ, ছিনতাইসহ সকল অপরাধের হটস্পট কবিরপুর সড়ক। নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের কবিরপুরে মাত্র ১ কিলোমিটার সড়কটি ভয়ঙ্কর হিসেবে এলাকাবাসীর নিকট পরিচিত। সন্ধ্যার পরে ভয়ে কেউই এ সড়ক ব্যবহার করতে চাননা। একই অবস্থা জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়কটিও।
স্থানীয়রা বলছেন, তিনটি গ্রুপের অন্তত ২০/২৫ জন ছিনতাইকারী ডাকাত সড়কটিকে নরকে পরিনিত করেছে। এরই মধ্যে পুলিশ একটি গ্রুপকে গ্রেফতার করলেও বাকি দুই গ্রুপ এখনও সক্রিয়।
তবে পুলিশ বলছে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। রাস্তায় ওয়াচ টাওয়ার বসানো হয়েছে। সিসি ক্যামেরাও বসানো হবে। এছাড়াও পুলিশি টহলও জোরদার করা হয়েছে।
জানা যায়, শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ার ব্যস্ত পথ নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়ক। এ মহাসড়ক যতটা সুন্দর তার থেকে বেশি ভয়ংকর। সড়কের কবিরপুর এলাকায় সন্ধ্যা হলেই ছিনতাই যেন নিয়মিত ঘটনা। সড়কে নারীদের একা পেয়ে শ্লীলতাহানির মতো ঘটনাও ঘটিয়েছে ছিনতাইকারীরা। তবে কোনো ধরনের অভিযোগ না করায় এমন ঘটনা চাপা পড়েছে দিনের পর দিন। পাশেই বেতার কেন্দ্রের বনায়ন থাকায় খুব সহজেই এসব কুকর্ম করে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে চক্রটি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের কবিরপুর এলাকার বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্র ৫৩০ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত। এই বেতার কেন্দ্রের আওতায় রয়েছে তিন স্তরের বিশাল বন। ভয়ে দিনেও এই বনে প্রবেশের সাহস দেখান না কেউ। মহাসড়কের পাশ দিয়ে এই বেতার কেন্দ্রের প্রাচীর থাকলেও কোথাও ধসে পড়েছে, কোথাও প্রাচীর ভেঙে যাতায়াতের সুব্যবস্থা করেছে ছিনতাই চক্র। তবে থানা পুলিশের তৎপরতা থাকলেও এসব প্রাচীর মেরামতের কোনো তৎপরতা নেই বেতার কর্তৃপক্ষের। ফলে ছিনতাই, ধর্ষণসহ নানা অপকর্ম চলছেই।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায় শিউরে ওঠার মতো বেশ কিছু চিহ্ন। গহীন বনের ভেতর দিনে প্রবেশ করলে গা শিউরে ওঠে। আর এই জঙ্গল যেন অপরাধীদের অভয়ারণ্য। বনের ভেতরে পড়ে থাকা ইয়াবা সেবনের সরঞ্জাম, নারীদের পাজামা, ভ্যানিটি ব্যাগ, সিগারেটের পাকেট, অটোরিকশার চাবি, গার্মেন্টস কর্মীর পরিত্যক্ত টিফিন বাটি- এসবই বলে দেয় এই বন অপরাধীদের আখড়া। আর এই বনাঞ্চল যেন নারীর সম্ভ্রম হারানো ও অসহায়ের আত্মচিৎকারের রাজসাক্ষী।
স্থানীয় রমজান আলী বলেন, কিছু দিন আগে রাত সাড়ে ১১টার দিকে জিরানীবাজারের ফরচুন প্লাজায় বসে ছিলাম। এমন সময় আতঙ্ক চোখেমুখে নিয়ে এক এক অটোরিকশা চালক কাছে এসে বলেন, দুটি মেয়ে জিরানীর দিকে সাইকেল চালিয়ে আসছিলেন। এ সময় চার থেকে পাঁচজন সাইকেলসহ মেয়ে দুটোকে বনের ভেতর নিয়ে গেছে। অটোরিকশা চালক বলেন প্রথমে কবিরপুর গিয়ে ঘটনা খুলে বলি কিন্তু কেউ বনে যাওয়ার সাহস দেখায়নি। পরে জিরানীবাজারে আসলাম। এসব শুনে পাশে থাকা শিল্প পুলিশের সহযোগিতা চাইলে তারা জানিয়ে দেয় এসব কাজ তাদের না। তবে যখন লোকজন নিয়ে আমি জঙ্গলে যাওয়ার উদ্দেশে রওয়ানা দিই তখন শিল্প পুলিশ আমাদের সঙ্গে যান। জঙ্গলে গিয়ে দেখি দুই মেয়ে বাইসাইকেলসহ পড়ে আছে। আমরা জিজ্ঞেস করি তাদের সঙ্গে খারাপ কিছু ঘটেছে কি না। উত্তরে তারা খারাপ কিছু ঘটার কথা স্বীকার করলেও থানায় অভিযোগ দায়ের করেননি। তারা সাইক্লিংয়ের সদস্য ছিলেন। জামাল আহমেদ নামে অপর এক ব্যক্তি বলেন, বেশ কিছু দিন আগে একজন নারী ভ্যানে যাওয়ার সময় চিৎকার করতে করতে যাচ্ছিলেন। পরে তার কাছে গিয়ে শুনি তার ভাগনিকে ভ্যান থেকে নামিয়ে জঙ্গলে নিয়ে গেছে ডাকাতরা। পরে আমরা গিয়ে ওই নারীকে জঙ্গলের ভেতর থেকে উদ্ধার করি। তবে সেখানে ডাকাতদের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। ভুক্তভোগী আমাদের কাছে স্বীকার করেছিলেন যে তাকে শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছিল। তবে কোনো ধরনের মামলা কিংবা অভিযোগ করতে চাননি।
সৌরভ নামে এক ভুক্তভোগী বলেন, আমি ও আমার এক বন্ধু নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের কবিরপুরের ওই জায়গা দিয়ে বাইকে যাচ্ছিলাম। এ সময় হঠাৎ সামনে একজন থামার জন্য সিগনাল দেন। না থামায় ডাকাতরা চলন্ত মোটরসাইকেলে হাতে থাকা দেশীয় অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে। এ সময় আমি একটু নিচু হলে সেই আঘাত আমার পেছনে থাকা বন্ধুর গায়ে গিয়ে লাগে। আমি সেখানে বাইক নিয়ে পড়ে গেলে বড় ধরনের অঘটন ঘটতে পারতো। এ রকম শত শত ভুক্তভোগী কবিরপুর এলাকাতেই পাওয়া যাবে। এরা খুবই ভয়ংকর!
স্থানীয় আসলাম উদ্দিন বলেন, সম্প্রতি স্বামী স্ত্রী মোটরসাইকেল নিয়ে যাচ্ছিলেন। পথের মধ্যে স্বামীকে কুপিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে জঙ্গলের ভেতরে চলে যায় দুর্বৃত্তরা। দুই দিন পর জঙ্গলের ভেতরে ওই নারী বিবস্ত্র অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।
তিনি বলেন, এ সড়কটিতে হয় না এমন অপরাধ নাই।
জানা যায়, তিনটি গ্রুপ এসকল অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে। এ গ্রুপের মধ্যে আরিফ নামের একটি গ্রুপের ৫ সদস্যকে গ্রেফতার করে। এ সময় তাদের নিকট থেকে বিপুল পরিমান দেশিয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। বাকি দুই হিমেল ও এরফানের গ্রুপ এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে।
এ সড়কের পাশাপাশি জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়কটিও ভয়ঙ্কর হয়ে দাড়িয়েছে। সন্ধ্যার পর ছিনতাইসহ নানা অপরাধ হচ্ছে এ সড়কে।
এদিকে গত ২৭ আগস্ট বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী সড়কে নেমে অবরোধ ও বিক্ষোভ করেন। প্রায় ৪ ঘণ্টা অবরোধের পরে পুলিশের হস্তক্ষেপে রাত ১টার দিকে সড়ক ছেড়ে দেন স্থানীয় জনতা।
এ ব্যাপারে আশুলিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) জিয়াউল ইসলাম বলেন, আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। সেখানে ওয়াচ টাওয়ার করা হয়েছে। পুলিশ নিয়মিত সেখানে থাকছেন। এখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে আশা করছি।
ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার আসাদুজ্জামান বলেন, এ সড়কের পরিবেশ এখন উন্নতির পথে। পুলিশি টহল বাড়ানো হয়েছে পাশাপাশি ডিবি পুলিশ ওই এলাকায় পর্যবেক্ষন করছে।
তিনি আরও বলেন, ওই এলাকায় অপকর্মকারীদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।