ঢাকা শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৮ই বৈশাখ ১৪৩১


মহাদেবপুরে মাটির প্রাসাদ !


২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৭:৪৯

সংগৃহিত

আবহমান গ্রামবাংলার ঐতিহ্য মাটির ঘর বা মাটির বাড়ি। এ ধরনের বাসস্থান শীত ও গরমের সময় বেশ আরামদায়ক। একসময় গ্রামের বিত্তশালীরা অনেক টাকা-পয়সা ব্যয় করে মাটির বাড়ি তৈরি করতেন। ইট, বালু ও সিমেন্টের আধুনিকতায় মাটির বাড়ি এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। তবে নওগাঁয় এখনো বহু মাটির বাড়ি আছে। এর মধ্যে জেলার মহাদেবপুর উপজেলার চেরাগপুর ইউনিয়নের নিভৃত পল্লী আলীপুর গ্রামে রয়েছে ১০৮ কক্ষবিশিষ্ট একটি দোতলা মাটির ঘর। ৩৩ বছর আগে শখ করে তৈরি করা এই বিরল ঐতিহ্যের বাড়িটি দেখতে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসেন পর্যটক-দর্শনার্থীরা। বাড়িটি সংরক্ষণ করা গেলে এটি অন্যতম একটি দর্শনীয় স্থান হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করে এলাকাবাসী।

১৯৮৬-৮৭ সালের দিকে আলীপুর গ্রামের সম্পদশালী দুই সহোদর সমশের আলী মণ্ডল ও তাহের আলী মণ্ডল প্রায় ৯ মাস সময় ধরে মাটির দোতলা ঘরটি তৈরি করেন। তিন বিঘা জমির ওপর নির্মাণ করা এই মাটির প্রাসাদের দৈর্ঘ্য প্রায় ৩০০ ফুট এবং প্রস্থ ১০০ ফুট। মাটি, খড় ও পানি মিলিয়ে কাদায় পরিণত করে ২০-৩০ ইঞ্চি চওড়া করে দেয়াল তৈরি করা হয়েছে। এটি তৈরিতে বিভিন্ন গ্রামের অন্তত ৮০ জন কারিগর একটানা কাজ করেছেন।

এই বাড়িটি তৈরিতে পশ্চিম পাশে একটি পুকুর খনন করা হয়েছে। আর ছাউনির জন্য টিন লেগেছে ২০০ বান। টিনের দোকানদার খুশি হয়ে দুই ভাইকে একটি চায়না ফনিক্স বাইসাইকেল উপহার দিয়েছিলেন। বাড়িসহ আশপাশে জমি রয়েছে প্রায় ২১ বিঘা। বাড়িটির সৌন্দর্য বাড়াতে চুন ও আলকাতরার প্রলেপ দেওয়া হয়েছে। প্রাসাদের মতো দেখতে এই বাড়িটির নাম ‘মণ্ডল ভিলা’ হলেও বর্তমানে ‘নওগাঁর মাটির প্রাসাদ’ নামে পরিচিতি পেয়েছে।

বাড়িটির ভেতরে গিয়ে এক কোণে দাঁড়ালে সব ঘর দেখা যেত এবং এক দরজা দিয়ে সব ঘরে যাওয়া যেত। বিশাল এই বাড়িতে প্রবেশের দরজা রয়েছে ১১টি। তবে প্রতিটি ঘরে রয়েছে একাধিক দরজা। দোতলায় ওঠার সিঁড়ি রয়েছে ১৩টি। বাড়ির মালিক সমশের আলী মণ্ডল ও তাহের আলী মণ্ডল কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। তাঁরা মারা যাওয়ার পর ছেলেরা বাড়িটি ভাগ করে নিয়েছেন। বাড়ির ভেতরের ফাঁকা অংশেও তৈরি করা হয়েছে আরেক বাড়ি। বর্তমানে বাড়ির শেষ অংশে ইট দিয়ে কিছু আধুনিকায়ন করা হয়েছে। ফলে আগের মতো বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে আর সব ঘর দেখা যায় না এবং সব ঘরে প্রবেশও করা যায় না। বিশাল এই বাড়িতে ছোট-বড় মিলে বর্তমানে ৪০ জন বসবাস করছেন।

নওগাঁ শহর থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে মহাদেবপুরের আলীপুর গ্রামের দূরত্ব প্রায় ২২ কিলোমিটার এবং মহাদেবপুর উপজেলা সদর থেকে দক্ষিণ-পূর্বে দূরত্ব প্রায় ৯ কিলোমিটার। নওগাঁ-মহাদেবপুর আঞ্চলিক সড়কের তেরোমাইল মোড় থেকে পশ্চিমে পাঁচ কিলোমিটার দূরে পিচঢালা পথ পেরিয়ে যেকোনো যানবাহনে যাওয়া যাবে ওই গ্রামে। যেতেই রাস্তার ডান পাশে যেকোনো পথচারীর নজর কাড়ে বিশাল রং করা কালো বাড়িটি। তবে পাকা রাস্তা থেকে ১০০ ফুট দূরে পুকুর আর সেই পুকুরের পারে কাঙ্ক্ষিত বাড়িটি। দর্শনার্থীদের আসার সুবিধার জন্য কয়েক মাস আগে পাকা রাস্তা থেকে বাড়ি পর্যন্ত প্রায় ২০০ ফুট হিয়ারিং রাস্তাও তৈরি করা হয়েছে।

জেলার পত্নীতলা উপজেলার আমন্তঝুঁকি গ্রামের মিজানুর রহমান, আফসার আলী ও মান্দা নিচকুলিহার গ্রামের শিক্ষক মহসিন আলী বলেন, তাঁরা অনেক দিন থেকে বাড়িটির নাম শুনেছেন, কিন্তু কখনো দেখার সৌভাগ্য হয়নি। এখন স্বচক্ষে দেখার পরে তাঁদের খুব ভালো লাগছে। তবে এত বড় বাড়ি জেলার কোথাও তাঁরা দেখেননি। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সেই সময় খুব যত্ন করে চুন ও আলকাতরা দিয়ে রং করে তৈরি করা হয়েছে বাড়িটি। সংরক্ষণ করা গেলে দর্শনীয় স্থান হয়ে উঠতে পারে।

নওগাঁর বদলগাছী উপজেলায় ঐতিহাসিক পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার জাদুঘর ও হলুদবিহার, ধামুইহাটে আলতাদিঘি, দুবলহাটি রাজবাড়ীসহ অনেক ঐতিহ্যবাহী দর্শনীয় স্থান রয়েছে। এর মধ্যে দর্শনার্থীদের মাঝে কৌতূহল জাগে প্রাসাদ আকৃতির মাটির বাড়িটি দেখার এবং যে দেখে সেই অবাক হয়। শুধু দেশ নয়, আধুনিক বিশ্বে এ যেন এক বিরল ঐতিহ্য।

মরহুম তাহের আলী মণ্ডলের স্ত্রী গৃহকর্তা হালিমা বেগম বলেন, গত কয়েক বছর থেকে বাড়িটি দেখার জন্য প্রতিদিন বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ আসছে। ঈদের সময় দিনে কয়েক হাজার মানুষের আনাগোনা হয়। তিনি বলেন, গৃহকর্তারা মারা যাওয়ার পর ছেলেরা বাড়িটি ভাগাভাগি করে নিয়েছে। এখন এক দরজা দিয়ে আর সব ঘরে যাওয়া যায় না। জায়গা সংকুলান না হওয়ায় অনেকে বাড়ির বাইরে গিয়ে বাড়ি করে বসবাস করছে।