ঢাকা মঙ্গলবার, ২৩শে এপ্রিল ২০২৪, ১১ই বৈশাখ ১৪৩১


১০০ টাকায় সুখ বেচে মুক্তা ও মহুয়া!


৩ অক্টোবর ২০১৮ ০৪:২৪

ফাইল ফটো

‘এই হিংসে করিসনে, ১০০ টাকা দে, সাপের খাবার কিনব, তুই অনেক সুখ পাবি, তোর কল্যাণ হবে।’ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় কথাগুলো বলে মানুষকে টাকা দিতে বাধ্য করছে বেদেনীরা। মানুষের পথ আগলে হরহামেশাই ঢাকার অলি-গলিতে এমন কথায় চাঁদা তুলছে বেদে তরুণী মহুয়ার মতো অনেক বেদেনী।

নগরীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ছোট সাপের বাক্স মেলে ধরে গতিরোধ করায় অস্বস্তিতে পড়ছে সাধারণ পথচারীরা। টাকা না দেওয়া পর্যন্ত পথ আগলে থাকে বেদেনীর দল। দশ-বিশ টাকা দিলেও মানছে না তারা।

দাবি করছে ১০০ টাকা। অনেক সময় বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পথচারীদের অশালীন গালিও দেয় এসব বেদেনী। এমন পরিস্থিতিতে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হতে হয় ব্যস্ত নগরীর পথচারীদের।

‘ও রানী সালাম বারে বার আমার নামটি জোছনা বানু আমি সাপ খেলা দেখাই’, ‘এই সিঙ্গা লাগাইবেন নি?’ এমনটাই ছিল একসময় বেদেনীদের পেশার মূলমন্ত্র।

গ্রামে বাড়িতে বাড়িতে সিঙ্গা লাগানো, দাঁতের পোকা তোলা, তাবিজ বিক্রি, সাপের কাটা রোগীর চিকিৎসা ও সাপ খেলা দেখানো ছিল বেদেনীদের একসময়ের কর্মকাণ্ড।

সাপের খেলা দেখিয়ে আর নানা কথায় ওষুধ বিক্রি করে চলতো ওদের সংসার। বিনাশ্রমে আয়ের লোভে এরা গ্রাম ছেড়ে শহরমুখী হয়েছে। মানুষকে সাপের ভয় দেখিয়ে পথ আগলে চাঁদা আদায়ই যেন এ শ্রেণির পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এসব কাজের কারণে বিপজ্জনক ও মানুষের অতিষ্ঠতা বাড়াছে বেদেনীদের ওপর। অনেক সময় বেদেনীদের ওপর অতিষ্ঠ হয়ে মারধরের ঘটনাও ঘটছে।

বেদেনী মুক্তার ভাষায়, ‘এই কাজ ছাড়া আমরা কী করুম। আমগরে কে কাজ দিব। কাজের লাইগা গেলে অনেকে ইজ্জতে হাত দেয়। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি বইলা আমগরে খারাপ মাইয়া মনে করে। আমগর কী পেট নাই? খাওন লাগে না? কেউ কাজ দেয় না, খালি উল্ডা- পাল্ডা কথা কয়।’

মানুষের পথ আগলে চাঁদা আদায়ের ব্যাপারে মুক্তা বলে, ‘কামটা (কাজ) খারাপ ঠিকই, কিন্তু আর কাম তো পাই না।’

আরিফুল ইসলাম নামে ভুক্তভোগী জানান, ‘সকালে অফিসে যাওয়ার পথে একদল বেদেনী পথ আগলে ধরে, দশ টাকা দিলাম তারা নেবে না, মানিব্যাগটা হাতে থাকায় মানিব্যাগে ওরা নিজেরাই হাত দিয়ে একশত টাকা নিল। পথচারীরা শুধু তামাশা দেখল অনেকে ওদের ভয়ে পাশকেটে চলে গেল। ব্যাপারটা আসলেই বিরক্তিকর।’

জানা যায়, বেদেনীর দল দেখলেই অনেকেই আতঙ্কে পড়েন। পাশকেটে যাওয়ার চেষ্টা করেন। প্রথমে বেদেনীর স্বাভাবিক আচরণ করলেও পরবর্তীতে তারা টাকা নিয়েই পথ ছাড়েন। কথনও গায়ে হাত বুলায়, অথবা সাপ গায়ে তুলে দিয়ে ভয় দেখায়, এতে একপ্রকার বাধ্য হয়েই পথচারীরা টাকা দিয়ে নিজেকে মুক্ত করেন।

যাত্রাবাড়ীর শিউলি আক্তার নামে এক ভোক্তভোগী বলেন, ‘মেয়েকে নিয়ে স্কুলে যাচ্ছি, পথে পাঁচ-ছয়জন বেদেনী পথ আটকে বলল, তোর চাঁন কপাল, এমন সুন্দর মেয়ে আল্লাহ। সাপের খাবার কিনব টাকা দে, আমার মেয়েতো সাপের ভয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দিল, পরে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে মুক্তি পেলাম।’

বেদেনী মহুয়ার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ‘তারা থাকে কেরানীগঞ্জ। তার ছয়জনের টিম, প্রতিদিন পোস্তগোলা হয়ে রাজধানীর অলিগলিতে টাকা উঠায়। প্রতিদিন তারা দুই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা চাঁদা তুলে।

অন্য কাজের কথা বলায় মহুয়ার ভাষায়, ‘কী কাজ করব? এখনতো কেউ সাপ খেলা দেখে না, তাবিজও কেনে না। তাই আমরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে টাকা উঠাই।’

এ প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ডেপুটি সেক্রেটারি এস এম আনসারুজ্জামান নতুন সময়কে বলেন, রাস্তায় এ ধরনের ভোগান্তি আসলেই আপত্তিকর। এ বিষয়ে জনস্বার্থে আমাদের একটি বিভাগ রয়েছে। তারা এসব দেখভাল করেন। বিষয়টি আমরা দেখব।

পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকার সাভার, মুন্সীগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, গাজীপুর, জয়দবেপুর, চট্রগ্রামরে হাটহাজারী, মরিসরাই, তনিটুর, কুমল্লিা, চৌদ্দগ্রাম, চান্দনিা, এনায়েতগঞ্জ, চাঁদপুর, উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় বেদেনীদের প্রাচীন আবাসস্থল। সুনামগঞ্জের সোনাপুর বাস বেদে সমাজের বৃহত্তর একটি অংশ। যাযাবর বলইে এদের জীবন বৈচিত্রময়।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের হিসেব অনুযায়ী এদের সংখ্যা প্রায় ৬৩ লাখ। যার মধ্যে দলিত ৪০ লাখ। বেদে আট লাখ ও হরিজন ১৫ লাখ।