ঢাকা শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১


বাংলাদেশের পেস বোলিং যেন কঁচিকাঁচার আসর


২ মার্চ ২০১৯ ০৫:৪৮

মেহেদি হাসান মিরাজ, আবু জায়েদ রাহি, খালেদ আহমেদ আর ইবাদত হোসেনে গড়া বোলিং সত্যিই অনভিজ্ঞ। বয়স ও ম্যাচ সংখ্যার আলোকে নেহায়েত নবীন। তাই তো নামী ক্রিকেট লিখিয়ে উৎপল শুভ্র বাংলাদেশের পেস বোলিংকে কচিকাঁচার আসর বলে অভিহিত করেছিলেন।

হ্যামিল্টন টেস্টের আগে বাংলাদেশের বোলিং সম্পর্কে লিখতে গিয়ে দেশ প্রসিদ্ধ এ ক্রিকেট লেখক লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশের পেস বোলিং যেন কঁচিকাঁচার আসর’। সেটা রসিকতা ছিল না মোটেই। খুনসুঁটি, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের চিহ্নও ছিল না তাতে। বরং সবাই সেটাকে সত্য কথা বলেই মেনে নিয়েছিলেন। হ্যামিল্টনে বাংলাদেশের বোলিং লাইনআপ সত্যিই আনকোরা, নবীনে ঠাসা।

যে চার বোলারে (মিরাজ ২১ বছর ১২৭ দিন, আবু জাইদ রাহি ২৫ বছর ২১১ দিন, খালেদ আহমেদ ২৬ বছর ১৬২ দিন আর ইবাদত হোসেন ২৫ বছর ৫৩ দিন) গড়া টাইগারদের বোলিং ডিপার্টমেন্ট, তাদের গড় বয়স ২৪’র কিছু বেশি। বয়সের তুলনায় তাদের টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতা আরও কম।

মেহেদি হাসান মিরাজ (১৮ টেস্টে ৮৪ উইকেট), আবু জায়েদ রাহি (৩ টেস্টে ৮ উইকেট) আর খালেদ (১ টেস্টে উইকেটশুন্য)। তিনজনের সাকুল্যে টেস্ট মোটে ২২ টি। আর ইবাদত হোসেনের যে এ ম্যাচেই অভিষেক। অফ স্পিনার মিরাজকে ব্র্যাকেটবন্দী করলে দুই পেসার আবু জায়েদ রাহি আর খালেদ আহমেদ মিলে এ টেস্টের আগে খেলেছেন মাত্র চার টেস্ট! আর ইবাদতের তো টেস্ট ক্যারিয়ার সবে শুরু হলো। ম্যাচসংখ্যায় সিনিয়র মিরাজ আবার বয়সে পেসারদের চেয়ে গড়ে ৪ বছরের ছোট।

এই নাম মাত্র টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতা নিয়ে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে কিউইদের বিপক্ষে টেস্ট খেলতে নেমে সফল হওয়া কঠিন। ইতিহাস বলছে ব্ল্যাকক্যাপসরা সব সময় দেশের মাটিতে দূর্বার। অনেক বাঘা বাঘা বোলারও নিউজিল্যান্ডের মাটিতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলে। ক্রাইস্টচার্চ, ওয়েলিংটন, হ্যামিল্টনের উইকেটে ঠিক কোন লাইন ও লেন্থে বল করলে সফল হওয়া যাবে, কিউই ব্যাটসম্যানদের অস্বস্তিতে ফেলা যাবে- তা বুঝতে বুঝতে অনেক সময় লেগে যায়।

তাই কঠিন সত্য হলো, নিউজিল্যান্ডের মাটিতে খেলার পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়া কিউই ব্যাটসম্যানদের টলানো বেশ কঠিন। তাই বলে কোন নতুন পেস বা ফাস্ট বোলার পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়া নিউজিল্যান্ডের মাটিতে টেস্ট খেলতে নেমে কিছুই করতে পারবে না- এমন নয়।

যাদের বলে গতি আছে, যারা প্রচন্ড গতির (অবশ্যই ১৪০ কিলোমিটার বা তার বেশী) সাথে সুইংয়ের মিশ্রণ ঘটাতে পারেন, যাদের হাতে আউট সুইং-ইনসুইং- দুই’ই আছে, তারা অবশ্যই সাফল্য পাবেন। কিন্তু নির্মম সত্য হলো, আবু জায়েদ রাহি, খালেদ আর ইবাদতের কারো তা নেই।

টিম সাউদি, ট্রেন্ট বোল্ট আর ওয়াগনাররা যখন ১৪৫+ কিলোমিটার গতিতে বল করে তামিম ছাড়া বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের নাভিঃশ্বাষ তুলে ছেড়েছেন, সেখানে বাংলাদেশের রাহি, খালেদ ও ইবাদত গড়পড়তা ১৩০-১৩৩ কিলোমিটার গতিকে বল করেছেন। কারো বলে সুইংও নেই তেমন।

১৩০’র আশপাশের বোলিং, তাও কোন রকম সুইং- ম্যুভমেন্ট ছাড়া যে নেহায়েত নির্বিষ, কমজোরি। এমন কমজোরি, ধারহীন বোলিং দিয়ে কিউই ব্যাটসম্যানদের বিপাকে ফেলা খুব কঠিন। হ্যামিল্টনে সে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি রাহি , খালেদ ও ইবাদতরা।

এমন অনভিজ্ঞ নবীন বোলারে সাজানো বোলিং নিয়ে কিউইদের বিপক্ষে মাঠে নামার ফলও হারে হারে টের পাওয়া যাচ্ছে। আজ দ্বিতীয় দিন শেষে নিউজিল্যান্ড রান পাহাড় গড়ে তুলেছে। টম লাথাম, জিত রাভাল আর কেইন উইলিয়ামসনরা স্বচ্ছন্দে-অনায়াসে তাদের মোকাবিলা করেছে।
বাংলাদেশের বোলাররা মিলে ১১৮ ওভারে মাত্র ৪ উইকেটের পতন ঘটাতে পেরেছেন। লাথাম আর রাভালের উদ্বোধনী জুটি ভাঙতেই ‘কম্ম কাবার’ হবার জোগাড়। কমজোরি, নির্বিষ ও ধারহীন বোলিংয়ের সাথে দূর্বল ক্যাচিংও ভুগিয়েছে।

আগের দিন শেষ সেশনে ইবাদতের প্রথম ওভারের দ্বিতীয় বলে লাথামের সহজ ক্যাচ ফেলে দিয়েছেন সৌম্য সরকার। ০ রানে জীবন পাওয়া লাথাম বিগ হান্ড্রেড (১৬১) করে নিউজিল্যান্ডকে অনেকদূর এগিয়ে দিয়েছেন।
ইবাদতের অফস্টাম্পের সামান্য বাইরে পিচ পড়া বল লাথামের ব্যাটের বাইরের কানায় লেগে চলে যায় স্লিপে।

সুবিধাজনক উচ্চতায় ঠিক মাথার ওপরে একদম হাতে যাওয়া ক্যাচ দুই বারের চেষ্টায়ও ধরে রাখতে পারেননি সৌম্য সরকার। একে তো কমজোরি বোলিং, তার ওপর হাতে আসা ক্যাচ ধরতে না পারা- দুয়ে মিলে অবস্থা করুণ।
তবুও রক্ষা। পেসারদের অকার্যকরিতায় অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ বল হাতে নিয়ে রাভালকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। অবশ্য তার আগেই শতরান পূর্ণ করে ফেলেছিলেন ৩০ বছর বয়সী ভারতীয় বংশোদ্ভুত জিত রাভাল। রিয়াদের বলে হাটু গেড়ে স্লগ করতে গিয়ে ক্যাচ তুলে আকাশে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন রাভাল (১৩২)।

তবুও রক্ষা অনিয়মিত বোলার সৌম্য সরকার তার জেন্টল মিডিয়াম পেস দিয়ে নতুন বলে ভালই বল করেছেন। সৌম্যর উইকেট সোজা ও গুড লেন্থ ডেলিভারিতে চা বিরতির পর অল্প বিরতিতে লাথাম আর রস টেলর (৪) ফিরে যান। এর মধ্যে বাঁহাতি লাথাম অফস্টাম্পের বাইরে ড্রাইভ করতে গিয়ে প্রথম স্লিপে ক্যাচ দেন মিঠুনের হাতে।


শূন্যে শরীর ছুড়ে অসামান্য দক্ষতা ও ক্ষিপ্রতায় লাথামের ক্যাচটি দুহাতে তালুবন্দী করেন মিঠুন। অন্যদিকে রস টেলর সৌম্যর গুডলেন্থ ডেলিভারিতে লেগবিফোর উইকেটের ফাঁদে জড়ান।


‘অকেশনাল’ সৌম্য পেসারদের অনুজ্জ্বলতার মাঝে খানিক আলোর ঝলক দেখালেও হ্যামিল্টন টেস্টে একটি সত্য দারুণভাবে ফুটে উঠেছে। তা হলো- এসব ফাস্ট বোলিং ফ্রেন্ডলি পিচে বাংলাদেশের পেস বোলিং নেহায়েত কমজোরি, নির্বিষ ও ধারহীন।

দেশের মাটিতে স্লো ও লো পিচে দুই তিনজন স্পিনার নিয়ে খেলে সাফল্য পাওয়ায় যে স্পিন নির্ভরতা চলে এসেছে- সেখান থেকে সরে আসা ছাড়া পথ নেই। উপলব্ধি করতে হবে, দেশের মাটিতে স্লো-লো আর টার্নিং পিচে সাকিব-মিরাজ ও তাইজুলরা বল ঘুরিয়ে স্পিন জাদুতে সবাইকে বশ করতে পারলেও দেশের বাইরে বিশেষ করে এশিয়ার বাইরে ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় ঐ ‘স্পিন থেরাপি’ মোটেই কাজে দেবে না।
সাকিব ব্যক্তিগত কারিশমায় কিছু করলেও বাকিদের ফাস্ট উইকেটে গিয়ে বল ঘোরানো এবং সাফল্য পাওয়া কঠিন। তাই পেস বোলিং লাইনকে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালি করা ছাড়া কোন পথ নেই। ঘরের মাঠে নির্জিব, নিষ্প্রাণ ও মরা পিচে খেললে লাভ হবে না। পেসারদের তৈরী করতে হবে। তাদের জন্য সবুজ ঘাসের দ্রুতগতির উইকেটে খেলার ব্যবস্থা করা অতি জরুরী। ঐ কন্ডিশনে নতুন নতুন পেস বোলার খুঁজে বের করতে হবে।

শুধু ১৩০ কিলোমিটার গতিতে উইকেট টু উইকেট বল করতে পারেন- এমন পেসারদের দিয়ে ওয়ানডে বা টি-টোয়েন্টি ফরম্যাট চলে। টেস্টে হবে না। গড়পড়তা ১৪০ কিলোমিটার গতিতে লম্বা স্পেলে বল করার শারীরিক সক্ষমতা আছে, যিনি দু’দিকে (অন্তত একদিকে) সুইং করাত পারেন, বাউন্সার ও ইয়র্কার ছুড়ে ব্যাটসম্যানকে ব্যতিব্যস্ত রাখার ক্ষমতা আছে- এমন ফাস্টবোলার তৈরীর কাজে মনোযোগী হতেই হবে। তাছাড়া গড়পড়তা মানের পেসারদের নিয়ে নিউজিল্যান্ডে খেলতে আসলে বার বার একই পরিণতি হবে।

কোয়ালিটি বা এক্সপ্রেস ফাস্টবোলারদের পাশাপাশি অন্তত একজন খুব ভালোমানের ‘রিস্টস্পিনার’ দরকারই। যার কি-না রশিদ খানের মতো বল ঘোরানোর অসামান্য ক্ষমতা থাকবে। সে মানের একজন উঁচুমানের লেগস্পিনার থাকলে এশিয়ার বাইরে ফাস্ট উইকেটেও ব্যাটসম্যানদের বুকে কাঁপন ধরাতে পারবেন। যার নজির আছে আব্দুল কাদির, অনিল কুম্বলে, দানিশ কানেরিয়া, মুশতাক মোহাম্মদ, নরেন্দ্র হিরওয়ানির বোলারদের। এসব বোলারদের ক্ষেত্রে উইকেট খুব বেশি বড় প্রভাবক নয়। কারণ তারা মূলত কব্জির ক্ষমতায় বল ঘোরাতে পারেন।

 

নতুনসময়/আশিক/আইকে