যেভাবে জাতীয় দলে এলো লিটন দাস

লিটন দাসের ক্রিকেট জীবন শুরু হয় জন্মশহর দিনাজপুরে। ১৯৯৪ সালে জন্ম নেয়া এই তরুণ বিকেএসপির ছাত্র ছিল। পরিবারের বড় ভাই বাপ্পি দাসও ২য় বিভাগের ক্রিকেটার। হয়তো ক্রিকেট অনুপ্রেরণা খুঁজে নিয়েছিলেন বড় ভাইয়ের কাছ থেকেই। কিন্তু পরিবার কিংবা বিকেএসপির ছায়া ছাড়িয়ে লিটন কুমার দাসের ক্রিকেটার হওয়ার পিছনের কারিগর আবু সামাদ মিঠু।
বর্তমান দিনাজপুর জেলা ক্রিকেট টিমের কোচ আবু সামাদ মিঠু। আমার বা আপনার কাছে একজন সাধারণ কোচের নাম হতে পারে তিনি কিন্তু লিটন দাসের কাছে এই নামের মাহাত্ম্য একটু বেশিই। কারণ লিটনের ক্রিকেট এর হাতেখড়ি যে এই মানুষটির হাত ধরেই। তার প্রিয় ক্রিকেটার অস্ট্রেলিয়ান ২০১৫ বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক মাইকেল ক্লার্ক। এছাড়াও একজন উইকেটরক্ষক হিসেবে অনুসরণ করতেন দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক উইকেটরক্ষক মার্ক বাউচারকেও।
দিনাজপুর অঞ্চলে খেলেছেন ‘প্রচেষ্টা ক্রিকেট ক্লাব’ এর হয়ে। সেখান থেকেই যাত্রা বিকেএসপিতে। পরবর্তীতে তিনি বয়সভিত্তিক প্রায় সব দলে খেলেছেন। বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব ১৫, অনূর্ধ্ব ১৯ এবং অনূর্ধ্ব ২১ এর পক্ষে দুর্দান্ত সব ইনিংসের পাশাপাশি উইকেটরক্ষক হিসেবে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। যিনি এখন ফুল তিনি যে কুঁড়ি থাকার সময় ঝলক দেখান নি; তা কিন্তু নয়। ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ইয়াং টাইগার্স জাতীয় স্কুল ক্রিকেট এ ৮ ম্যাচে ৪১৪ রান আর ১৫ ডিসমিসাল করে ৫৩৯ স্কুলের মধ্যে টুর্নামেন্ট সেরা হয়েছিল বিকেএসপি’র এই তরুণ। পরে মাত্র ১৭ বছর বয়সে ২০১২ সালে অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের জাত প্রমাণ করেন দিনাজপুরের ক্রিকেটার লিটন দাস। অস্ট্রেলিয়ার কঠিন কন্ডিশনে ৬ ম্যাচে ১ সেঞ্চুরি ও ২ হাফ সেঞ্চুরিসহ ২৬২ রান করেন লিটন। এনামুল হক বিজয়ের ঠিক পরেই ছিলেন বাংলাদেশীদের হয়ে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকদের তালিকায়। সেখানেই থেমে থাকেননি ডান হাতি এই ব্যাটসম্যান। ২০১৪ তে অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপে প্লেট ফাইনালে ৭৫ বলে ৮০ সহ ৬ ম্যাচে ৫০ গড়ে তিনি করেন ২০০ রান। এখানেও ছিলেন দ্বিতীয় অবস্থানেই। ঠিক সাদমান ইসলাম অনিকের নিচে।
তারপর থেকে বয়স ভিত্তিক দল বাদেও ঘরোয়া ক্রিকেট এ তার জয়রথ চলছেই। ডিপিএলের ২০১৪-১৫ মৌসুমে ১৬ ম্যাচে ১ শতক আর ৫টি অর্ধশতকে ৪৩ গড় আর ৯১ স্ট্রাইকরেটে তোলেন ৬৮৬ রান যা ওই টুর্নামেন্টের ২য় সর্বোচ্চ রান ছিলো।
১৯৯৯-২০০০ মৌসুমে শুরু হওয়া জাতীয় লিগে এর আগে কোন ব্যাটসম্যান ৪ টির বেশি সেঞ্চুরি করতে পারেন নি। কিন্তু ২০১৫ লিগের শেষ রাউন্ডের ম্যাচে ঢাকা মেট্রোর বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে ১০৭ করে এক আসরে সব থেকে বেশি ৫ টি সেঞ্চুরি করে নতুন এক কীর্তি গড়েন তিনি। তারপর দ্বিতীয় ইনিংসে করেন ৭৭ রান। পাশাপাশি হাফ সেঞ্চুরি ছিল ৩টি। এরই সাথে রেকর্ড করেছেন আরেকটি-১৩ বছর পর জাতীয় লিগে কোন ব্যাটসম্যান ১ হাজার রান পার করেন। ২০০১-২০০২ মৌসুমে ১৫ ইনিংসে ১০১২ রান করেন চট্টগ্রামের মিনহাজুল আবেদীন নান্নু। আর লিটন করলেন ঠিক ঠিক ১০২৪; তাও কিনা নান্নুর থেকে ২ ইনিংস কম ব্যাট করে!!
৫ টা সেঞ্চুরি করেছেন ভাল কথা কিন্তু এর মধ্যে আবার আবার ৩ টাই দেড়শ পেরুনো ইনিংস-এমন ব্যাটসম্যান কে বাংলাদেশ টিম তাঁদের পাইপলাইন এ রাখবে এমনটাই স্বাভাবিক।
উইকেট এর পিছনেও যে তিনি কম যান না এর প্রমাণ সেই বয়সভিত্তিক টিম থেকেই দিয়ে আসছেন। ২০১৪-১৫ ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে ছিলেন টুর্নামেন্টের সেরা উইকেটকিপার। ঢাকা আবাহনীর হয়ে ১৬ ম্যাচে ২২ টি কাচ আর ৭ টি স্ট্যাম্পিং করেন এই উইকেট ব্যাটসম্যান।
এমন এক প্রতিভা কে যে কেউ তাঁর দলে দেখতে চাইবেই। কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিক পারফরমেন্স এর পুরস্কার হিসেবে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড বিশ্বকাপের ৩০ জনের প্রথমিক স্কোয়াডে জায়গাও পেয়ে গিয়েছিলেন। মাঝখানে এনামুল বিজয় এর ইনজুরিতে তাঁর সুযোগও আসতে পারত কিন্তু সে যাত্রায় ইমরুল কায়েস এর জন্য সুযোগ আর আসে নি। এবার যখন এত প্রতীক্ষার পর টি-২০ আর টেস্ট এর জাতীয় দলের দরজা তাঁর জন্য খুলে গেছে তখন অবশ্যই তিনি চাইবেন সুযোগের সেরা ব্যবহার করতে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে টি-২০ তে স্কোয়াড এ থাকলেও মূল দলে সুযোগ আসেনি।
সুযোগ এলো ভারতের বিপক্ষে টেস্টে। স্কোর ১৭২/৫। ফলোঅন এড়াতে তখনও লাগে ৯০ রান। ঠিক তখনই নামেন তিনি। সঙ্গীর অভাবে ভোগা লিটন অষ্টম ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হবার আগে ৪৫ বলে ৪৪ রান করেন, ৮ চার আর ১ ছক্কায়। কমেন্ট্রি বক্সে বসা প্রতিটা ধারাভাষ্যকর সেদিন প্রশংসা করেছিলেন লিটনের। অশ্বিন, হরভজনকে দারুণ হাতে সামলেছিলেন। কমেন্ট্রি বক্সে হার্শা ভোগলে বলেই বসল এতটা ক্লাসি প্লেয়ার আমি কখনই দেখি নাই।
পরের ম্যাচে সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে একমাত্র ইনিংসে তুলে নেন প্রথম ফিফটি। এই ইনিংসেও ১৯৫/৫ রানের সময় উইকেটে আসেন লিটন। অষ্টম ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হবার সময় করেন ৫০ (১০২)! জুটি গড়েন সাকিব আর মোহাম্মদ শহীদের সাথে। জুটি গড়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সাত নাম্বারে কিছু রিস্ক ব্যাট হাতে নিতেই হয়, না হয় বাংলাদেশের বর্তমান টেলেন্ড কি আর ভরসা করার মতো।
ভারত ট্যুরের ওয়ানডে সিরিজেই ডেবু হয় তার। ৩ ম্যাচে করেন ৮(১৩), ৩৬(৪১) ও ৩৪(৫০) সব মিলিয়ে ২৬ গড় আর ৭৫ স্ট্রাইকরেটে করেন ৭৮ রান। পরে সাউথ আফ্রিকা সিরিজে টি২০ অভিষেক হয়। সেদিন ৭ নম্বরে নেমে যেখানে ১টি ছক্কার মারে ২৬ বলে করেন ২২ রান। ওই ছক্কাটি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের ১০০০ তম ছক্কার মার। যদিও ম্যাচটি আমরা হেরেছিলাম টপ অর্ডারের ব্যার্থতায়। তবে ওয়ানডেতে লিটন খুব একটা ভালো করতে পারেনি সেই সিরিজে। ০(১), ১৪(১২), ৪(৪)* এর পরই বাদ পড়তে পারতেন। তবে ভারতে এ দলের হয়ে ৩ ম্যাচে ৪৭ গড়ে ১টি ৫০ সহ করেন ১৭৫ রান। যার ফলে নভেম্বরে ঘরের মাঠে জিম্বাবুয়ের সাথে আবারও সুযোগ পান।
ওয়েস্ট ইন্ডিস সফরে লিটন আবার নিজেকে প্রমাণ করেছে। ৩৯ বলের ৬৩ রানের ঝড়টা ক্রিকেট ভক্তরা মনে রাখবে অনেক দিন। এবারের এশিয়া কাপে তামিমের সঙ্গী হয়ে জাতীয় দলের স্থানটা পাঁকা করবে লিটন দাস এমনটাই আশা করছে তার ভক্তরা।
এমএ