ঢাকা শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৮ই বৈশাখ ১৪৩১

আমি শ্রমের মূল্য পাইনি, পেয়েছে বিবাহিত নিষ্ক্রিয়রা: শ্রাবণী দিশা


১৮ মে ২০১৯ ০৭:৩৭

ঘটনার বিবরণ দিতে চাইনি তবুও দিতে হচ্ছে। কমিটি ঘোষণার পর দেখলাম আমার নাম নাই, বুঝে গেলাম এই ছাত্রলীগ কতটুকু শ্রম ঘামের মূল্য দিয়েছে। মন আর খারাপ করলাম না। সারাদিন রোজা রাখার পর ইফতার করছি এমন সময় সম্পা আপুর ফোন, বলল মেয়েদের লাঞ্চিত করা হয়েছে। আমি বললাম রোজা রেখেছিলাম, ফেসবুকে যাওয়া হয়নি। পরে ভাবলাম অন্তত প্রেস ব্রিফিং এ গিয়ে ওদের পাশে দাঁড়াই।

ওখানে গিয়ে বসবো ঠিক এমন সময় জিয়া হলের জি এস শান্ত আর আমার ব্যাচমেট অনিকের নির্দেশে জুনিয়ররা সবার উপর পানি ঢেলে দেয়। আর একটা ছেলে এসে ব্যানারটা টান দিয়ে ছিড়ে ফেলে। আর তখনই শান্তর নির্দেশে আমাদের উপর গ্লাস, জগ, চেয়ার ছুড়ে মারা হয়। একটা গ্লাস এসে আমার চোখে লাগে এবং এর পরের অবস্থা সবাই ভিডিওতে দেখেছেন।

আমি ওই চোখে কিছুই দেখতে পারছিলাম না। যন্ত্রনায় যখন চিৎকার করছিলাম তখন আমাকে হাসপাতালে নেওয়ার মতোও কেউ ছিলো না। কেন না আমার সাথের সবাইকে ওরা ঘিরে মারধর করছিলো। মিডিয়ার লোকজন গুলোও তাদের চ্যানেলের টিআরপি বাড়ানোর চিন্তায় ছবি তুলতে ব্যস্ত। এখানে একজন বাঁচে কি মরে এতে তাদের কি এসে যায়!
সম্ভবত সাইফুর ভাই এসে আমাকে ওখান থেকে বের করে। আমাকে হাসপাতালে নেওয়ার মতো কোনো যানবাহনও পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই প্রায় রাজু ভাস্কর্য পর্যন্ত হেটে গিয়ে রিকশায় উঠি। পাশে ফরিদা আপু ছিল, তাকে বললাম সৌরভকে ফোন দিতে। আমাকে ডিএমসির তিন তলায় নিয়ে যাওয়া হয় আর সৌরভ যায় সুতা কিনতে। একজন অল্পবয়সী নারী ডাক্তার আমাকে দেখে বলল, সুন্দর মেয়েটার মুখে এত বড় ক্ষত হয়ে থাকবে! আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমি চোখে দেখতে পারবো তো? তারপর তিনি যত্ন নিয়ে সেলাই করলেন। সেলাই শেষে উনি বললেন উপরে নিচে ৯টা করে মোট ১৮ টা সেলাই লেগেছে।

উনি জানতে চাইলেন লিখে দিবেন কিনা, তাহলে আমি মামলা করতে পারবো। আমি বললাম, না কার বিরুদ্ধেই বা মামলা করবো, মামলা করলেই কি আর তার বিচার হবে? এরপর সেলাই রুম থেকে আমাকে বের করে আনা হয়। আমাকে ওরা সবাই মিলে পাশের রুমে নেয়, আর একটি কাঠের বেঞ্চে একটি ব্যাগের উপর মাথা দিয়ে শুয়ে থাকি।

এদিকে সৌরভ যায় টিটি টিকা আনতে। তখনই হাসপাতালে যায় বাণী ইয়াসমিন হাসি আপু আর এফ এম শাহীন ভাই। হাসি আপু তখন এসে আমাকে দেখে কান্না লুকাতে পারছিলো না। আপু বললো এখানে এত গরমে এভাবে থাকলে আরও অসুস্থ হয়ে যাবে। এর থেকে চলো আমি তোমাকে তোমার কোনো আত্মীয়ের বাসায় দিয়ে আসি। আমি বললাম, আপু এখানে তো আমার কোনো আত্মীয়ের বাসা নেই। আপু বলল তাহলে আমার বাসায় চলো। আমি বললাম নিয়ে চলেন আপু। কারণ ওই মূহুর্তে আমার একমাত্র চিন্তা আমাকে বাঁচতে হবে। এরপর আপুর সাথে আপুর বাসায় চলে আসি। সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত আপুর এখানেই আছি। আমার সার্বক্ষণিক যত্ন, আমার খাবার, ওষুধপত্র এসব কিছুর খেয়াল রাখছেন আপু। আপু সহ Sonjit Chandra Das দাদা, Abid Al Hasan ভাই, Jashim Uddin ভাই মিলে আমাকে হারুন আই হসপিটালে নিয়ে যায়। সেখানকার ডাক্তার আমাকে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান হাসপাতালে রেফার করে। আমাকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়।

পরদিন সকালে কসমেটিক সার্জারির জন্য আবারো আমাকে আপু সেই হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে আমার চোখের পরীক্ষার পর জানতে পারি আমার চোখের ভিশনে কিছু সমস্যা রয়েছে। আমাকে আবার ৭দিন পর ফলো আপ এর জন্য যেতে বলা হয়। কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি সঞ্জিতদা, জসিম ভাই, শাহিন ভাইয়ের প্রতি। কৃতজ্ঞতা জানাই, আমার নেতা, আমার ভাই আবিদ আল হাসানের প্রতি। যারা এক মুহূর্তের জন্যও আমাকে বুঝতে দেননি যে এ শহরে আমার কেউ নেই, আর একজনকে কৃতজ্ঞতা জানানোর মতোও ভাষা আমার কাছে নেই, যিনি বোন নয় মায়ের মতো করে এই সময়টাতে আমাকে আগলে রেখেছেন।

রাজনীতির জন্য অনেক কিছু হারিয়েছি। ডাকসু নির্বাচনে নিজের সংগঠনের জয় নিশ্চিত করতে গিয়ে মাস্টার্স এর পরীক্ষাটাও দেওয়া হয়নি। নানক ভাই, আবদুর রহমান ভাই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে আমাকে মূল্যায়ন করা হবে। কিন্তু তখন কোনো পোস্ট এর আশা না করে, শুধুমাত্র নিজের আদর্শ ও সংগঠনের প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে নিজের পরীক্ষা বিসর্জন দিয়ে নিরলস শ্রম দিয়ে হল সংসদে ছাত্রলীগের প্যানেলের জয় নিশ্চিত করেছি। এই শ্রমগুলোর কোনো মূল্য আমি পাইনি। পেয়েছে একাধিকবার বিবাহিত, রাজনীতির মাঠে নিস্ক্রিয় সামিয়া সরকার, মিসওয়ার্ল্ডের লাবনীর মতো কিছু বিতর্কিত মেয়েরা। তাই এখন আমার আশা ভরসার সবটুকুই শুধু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আপার কাছে।

লেখক: সাধারণ সম্পাদক, রোকেয়া হল ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


নতুনসময়/এনএইচ