ঢাকা শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১


কোরআন এক জিন্দা মুজিজা


১৩ মার্চ ২০২১ ১৭:৫১

প্রতিকি

আল-কোরআন এক জিন্দা মুজিজা। এ মহাগ্রন্থ পূর্ণাঙ্গ এবং গভীর প্রকৃতির স্বভাব সুন্দর জীবন বিধান। আল-কোরআন মানবতার মুক্তির রাজপথ। এটি রাষ্ট্রের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ শাসনতন্ত্র। এ প্রসঙ্গে ড. মোরেল বলেন, আল-কোরআন শ্রেষ্ঠ আসমানি কিতাব। আমরা জোর দিয়ে বলতে পারি যে, মহাপরাক্রমশালী সৃষ্টিকর্তা বিশ্ব মানবের কল্যাণে যেসব গ্রন্থ এ পৃথিবীতে সৃষ্টি করেছেন, তার মাঝে সর্বাধিক মর্যাদা ও তাৎপর্যপূর্ণ হলো আল-কোরআন। মানবতার মুক্তি ও কল্যাণের জন্য এর বাণীসমূহ গ্রিক দর্শনের চেয়ে বহুগুণে শ্রেষ্ঠ। এর প্রতিটি অক্ষর ও শব্দ মহান আল্লাহর বড়ত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনায় সত্যিই বাঙ্ময়। কোরআন একদিকে যেমন জ্ঞানীদের শব্দভান্ডার; অন্যদিকে কবিদের জন্য কাব্যলংকারের সমারোহ। তেমনি ঐতিহাসিক শাসক ও বুদ্ধিজীবীদের কাছে এর গুরুত্ব ও সমাদর এনসাইক্লোপিডিয়ার চেয়েও বেশি।

কোরআন সত্য। আর সূর্যের মতো সত্যের একটি নিজস্ব শক্তি ও আলো আছে। তাই সত্যকে গলাটিপে হত্যা করা যায় না। মেঘের ফাঁকে যেমন সূর্য হাসে, তেমনি মিথ্যার কালো পর্দা ছিঁড়ে সত্য বেরিয়ে আসে। নদীর বুকে বাঁধ দেওয়া যায় কিন্তু সুনামির পায়ে শিকল পড়ানো যায় না। মোমবাতিকে ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু সূর্যকে ফুঁ দিয়ে নেভানো যায় না। কোরআন হলো আলোকিত সূর্য, সিরাজাম মুনিরা। তাকে চক্রান্তের ফুঁ দিয়ে নিভানো যাবে না। কোরআন এক মহাসত্য। এ গ্রন্থ নিজের শক্তিতে শক্তিমান। কোরআনই তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত ও বিভ্রান্তির মোকাবিলা করতে সক্ষম। কোরআনের কোনো সাহায্যের প্রয়োজন নেই। কোরআন চাঁদ নয়, সূর্য। তার জন্য কোনো ঠিকাদার কিংবা হেলপারের প্রয়োজন নেই।

কোরআন নাজিল হয়েছে আরবের কাব্যের যুগে। কোরআনের অলৌকিক ছন্দের ঝংকার, লালিত্য-মাধুর্য, বিষয়বস্তুর উচ্চতায় বাকপটু আরবদের পিলে চমকে ওঠে। চোখ ধাঁধিয়ে ওঠে, অনেকটা পেচকের মতো। তাদের কেউ কেউ বললো- কোরআন শয়তানের কথা, কেউ কেউ বললো- গণকের কথা, কেউ বললো- কবির কথা। অথচ হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবি, গণক, জাদুকর কিছুই ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন উম্মি বা নিরক্ষর মানুষ। ইতিহাস সাক্ষী তিনি চারণ কবি ছিলেন। জীবনে কোনো কবির আসরে পা রাখেননি। তাঁর দ্বারা কী করে সম্ভব কোরআনের মতো বিজ্ঞানময়, জ্যোতির্ময় মহাগ্রন্থ রচনা করা? আল-কোরআন মানবীয় গ্রন্থ নয়। তাই এর মোকাবিলা করা আরবের কবিদের সম্ভব হয়নি। সে যুগের শ্রেষ্ঠ কবি ‘লাবিদ’ স্বীকার করে ঘোষণা দিলেন এটি কোনো মানবীয় কাজ নয়।

এটা ঐতিহাসিক সত্য যে, কোরআন হলো মানবজাতি ও মানব সভ্যতার রক্ষাকারী। মধ্যযুগে মানব ও মানব সভ্যতা যখন ধ্বংসের মুখোমুখি, মানবসমাজ ভাঙন, বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যের তোড়ে ভেসে যাচ্ছিল, তখন আল-কোরআন মানুষ ও পৃথিবীকে রক্ষা করে। কোরআন বিপন্ন মানবতাকে মুক্তি দেয়। সৃষ্টি করে মানবিক ঝড়। সে ঝড়ে অমানবিক সমাজ কাঠামো ভেঙে যায়। এ প্রসঙ্গে কমিউনিস্ট চিন্তাবিদ এম. এন. রায় বলেন, ‘মোহাম্মদের কঠোর একেশ্বরবাদ আরবীয় মুসলমানদের তলোয়ার সঞ্চালনে এমন অজেয় ক্ষমতা দান করলো যে, তা কেবল আরব উপজাতিগুলোর দুটি পৌত্তলিক নষ্ট করলো না; বরং জড় খ্রিস্টের অপপ্রচার থেকে আচার ভ্রষ্ট খ্রিস্টধর্মের অঘটন ও অন্ধবিশ্বাস থেকে মঠ ও শঠাধ্যক্ষ সন্নাসী সংক্রমিত মারাত্মক বাক্যাধির হাত থেকে অগণিত মানুষকে মুক্তি দেওয়ার জন্য ইতিহাসের প্রধান ও একমাত্র সহায় হয়ে রইল।’

সামাজিক ভাঙন ও আত্মিক হতাশার সে গভীর অন্ধকারে আরবের নবীর উদ্দীপনায় আশার বাণী আবার আলোক শিখার মতো সহসা প্রদীপ্ত হয়ে উঠল। নৈরাজ্যের অতলে নিমজ্জিত এক জাতির সামনে ইসলাম খুলে দিল আশার এক নতুন দিগন্ত। বাহ্যিক দৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে ইসলামের তলোয়ার আল্লাহর নামেই সঞ্চারিত হয়েছে। কিন্তু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, কার্যত তা করেছে সকল ধর্ম ও বিশ্বাসের সমাধি রচনা...। ইসলামের বিপ্লবই বাঁচিয়ে ছিল মানুষকে। মধ্যযুগে কোরআন মানব ও মানব সভ্যতাকে রক্ষা করে। মানবজাতিকে চোরাবালি থেকে রাজপথে আনে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ করো। তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে এবং তিনিই তোমাদের হূদয়ে প্রীতি সঞ্চার করেন। ফলে তার দয়ায় তোমরা পরস্পর ভাই হলে। তোমরা অগ্নিকাণ্ডের প্রান্তে ছিলে, অতঃপর তিনিই তোমাদের উদ্ধার করেন।’

কোরআন কালজয়ী পরশপাথর। এর জাদুর স্পর্শে মৃত মানবতায় প্রাণসঞ্চার হয়। কোরআনের মানবিক ঝড়ে পৃথিবীর পাশবিকতার লাগাম ভেঙে যায়। মানব ইতিহাস নতুন পথে বাঁক নেয়। গড়ে উঠে মানবিক সভ্যতা। আজব সংঘাতময় পৃথিবীকে কোরআন বাঁচাতে পারে। গড়ে তুলতে পারে ভারসাম্য, যা ইউরোপীয় প্রযুক্তির অগ্রগতির পরশে নষ্ট হয়েছে। আজ ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের অতিরিক্ত উন্নয়নের গ্রাস থেকে একে বাঁচানোর জন্য আমাদেরকে অবশ্যই দারস্থ হতে হবে ইসলামী সমাজের। মর্যাদার সুযোগের এসব উদ্যমের সাম্যে এতগুলো মানবগোষ্ঠীকে একতাবদ্ধ করার সফল ইতিহাস আর কোনো সমাজে নেই। এই একটিমাত্র গ্রন্থ মানব ও মানব সভ্যতার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে, সৃষ্টি করেছে মানবিক ঝড়। সে ঝড়ের তোড়ে ভেঙে যায় শত শতাব্দীর অমানবিক পরগাছা, সমাজবিন্যাস, রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও সভ্যতা। লাঞ্ছিত নির্যাতিত মানবতাকে শোনায় মুক্তির গান। দেখায় মুক্তির রাজপথ। ডাক দেয়- আলোর পথে, মুক্তির পথে, কল্যাণের পথে, হেদায়াতের পথে। ডাক দেয়- অত্যাচারী শাসকের জিন্দান ভাঙতে, দানবীয় শক্তির নখর দণ্ড উপড়ে ফেলতে, পেশিশক্তির কালো হাত গুঁড়িয়ে দিতে, অসাম্যের প্রাচীর ভাঙতে, সাম্য মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের মিছিলে শামিল হতে। সকল বাধা ছিন্ন করে খোলা আকাশের নিচে সমবেত হতে। মুক্তির রাজপথে জোর কদমে এগিয়ে যেতে।

আল-কোরআনের ডাকে ঘুমের পাড়ার ঘুম ভাঙে। এতে রয়েছে কালজয়ী বিপ্লবের ডাক। এ মহাগ্রন্থ বদলে দেয় মানুষ ও মানুষের জীবনধারা বিশ্বাস, মূল্যবোধ, চিন্তা-চেতনা, ধর্ম-কর্ম, আচার-আচরণ, মন-মনন। এর বিপ্লবের অনল প্রবাহ গিরিধারী মরুপ্রান্তর। আছড়ে পড়ে এর উত্তাল তরঙ্গ চীনের মহাপ্রাচীরে, মিশরের পিরামিডে, হিমালয়ের পাদদেশে, ভারত মহাসাগরের সৈকতে, আটলান্টিক মহাসাগরের বেলাভূমিতে। কাঁপন ওঠে এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকার দেশে দেশে। ভেঙে যায় ঘুমের পাড়া, পালটে যায় বিশ্বাস, মূল্যবোধ, জীবনধারার মানচিত্র, উলটে যায় সভ্যতার সংস্কৃতি। বদলে যায় মানুষ, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র। এতে মানবিকতার হলো মহামুক্তি। মুক্ত মানবতার জয়গানে চারদিক হলো মুখরিত। মানবতার হলো পাপমোচন।

অসাম্য ও পাশবিকতার বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে কোরআন মানুষকে ডাক দেয়। বর্ণবাদ, জাতীয়তাবাদ, অভিজাত্য ইত্যাদি ভেদাভেদের প্রাচীর ভাঙতে ডাক দেয় এ মহাগ্রন্থ আল-কোরআন। এর প্রভাব বিভিন্ন জাতির প্রাচীন চিন্তাধারা ও সুপ্ত প্রতিষ্ঠানসমূহ পুনরুজ্জীবিত হয়। গ্রিক, পারস্য, মিশর, মেসোপটেমিয়ার প্রাচীন জাতিসমূহের উপ্ত সভ্যতার মরা কবরগুলো নতুন জীবনের জয়গানে জেগে ওঠে। বিরান মাঠ, মরুপ্রান্ত সোনার ফসলে ঢেউ খেলে। হতাশার বুকে জ্বালায় আশার চেরাগ। মানুষের সামনে খুলে দেয় অনন্ত সম্ভাবনার দ্বার। নতুন বিশ্বাসে মানুষ মাথা তুলে দাঁড়ায়। প্রতিবাদে হাত মুষ্টিবদ্ধ-দাসত্বের শিকল ছিড়ে ফেলে। সাম্য, মৈত্রী, ভ্রাতৃত্বের মিলন মেলার স্বপ্ন দেখে। আল-কোরআন মানবজাতিকে হাতছানি দেয় দিগ্বিজয় ও বিশ্বজয়ের। বুকে জাগায় আশা-স্বপ্ন; চোখে দেখায় শান্তি সুখের নতুন পৃথিবী। মানুষের সামনে খুলে যায় নতুন সভ্যতার সংস্কৃতির নতুন রাজপথ। জয়দীপ্ত পদে মানবজাতি খোলা আকাশের নিচে আলোর মিছিলে বেরিয়ে পড়ে। মানুষ ছুটে চলে নতুন পৃথিবী, নতুন সভ্যতা গড়তে। তার পায়ে আজ শিকল পরায় কে? আল-কোরআনের কালজয়ী ঘোষণা- ‘আর বলো, সত্য সমাগত। মিথ্যা বিতাড়িত। নিশ্চয়ই মিথ্যা ধ্বংস হবে।’

আল-কোরআন চির সত্য। এই সত্য থাকবে অনন্তকাল। দুনিয়ার সব মানব-দানব একত্রিত হয়েও কোরআনের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। কোরআন আল্লাহর কালাম। আল্লাহ স্বয়ং এর রক্ষক। কোরআন রক্ষার দায়িত্ব আল্লাহ তায়ালা মানুষকে দেননি, নিজের হাতে রেখেছেন। কারণ এর হেফাজতের যোগ্যতা মানুষের নেই। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন- ‘নিশ্চয়ই আমি এই উপদেশ (কোরআন) নাজিল করেছি, আর আমিই এর সুনিশ্চিত রক্ষক।’

লেখক : শিক্ষার্থী, আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া হামিউচ্ছুন্নাহ মেখল, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম