ঢাকা রবিবার, ২১শে সেপ্টেম্বর ২০২৫, ৭ই আশ্বিন ১৪৩২


মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের পরবর্তী টার্গেট কি তুরস্ক?


২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৫:০০

সংগৃহীত

কাতারে ইসরায়েলের সাম্প্রতিক বিমান হামলার পর, আঙ্কারায় বাড়ছে উদ্বেগ—তেলআবিবের আঞ্চলিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে এখন তুরস্কও রয়েছে সতর্ক অবস্থানে।

 

গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ উপসাগরীয় মিত্র কাতারে বিমান হামলা চালানোর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইসরায়েলি বিশ্লেষকদের দৃষ্টি ঘুরে যায় তুরস্কের দিকে।

 

ডানপন্থী আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ গবেষক মাইকেল রুবিন বলেন, তুরস্ক হতে পারে ইসরায়েলের পরবর্তী লক্ষ্য এবং সতর্ক করেন, ন্যাটো সদস্যপদ তুরস্ককে রক্ষা করতে পারবে না।

 

ইসরায়েলি অ্যাকাডেমিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মেইর মাসরি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখেন, আজ কাতার, কাল তুরস্ক। এর জবাবে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের একজন উপদেষ্টা তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, ইসরায়েলের যদি তুরস্কের ওপর হামলার চিন্তা করে তাহলে ভয়াবহ শাস্তি দেশটির জন্য অপেক্ষা করছে।

 

বিগত কয়েক মাস ধরেই ইসরায়েলি মিডিয়াগুলো তুরস্ককে ‘ইসরায়েলের সবচেয়ে বিপজ্জনক শত্রু’ হিসেবে চিত্রিত করে আসছে। বিশেষ করে, পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তুরস্কের উপস্থিতি ও যুদ্ধ-পরবর্তী সিরিয়ায় দেশটির পুনর্গঠনে ভূমিকা—এই বিষয়গুলোকে ইসরায়েলি বিশ্লেষকরা ‘নতুন হুমকি’ হিসেবে বর্ণনা করছেন।

 

তুরস্ক-ইসরায়েল উত্তেজনা কোথায় যাচ্ছে?

গাজায় চলমান যুদ্ধ এবং আঞ্চলিক আগ্রাসনের মধ্যেই তুরস্ক আগস্টে ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থগিত করে পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেয়।

 

আটলান্টিক কাউন্সিলের নন-রেসিডেন্ট ফেলো ওমর ওজকিজিলসিক কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে বলেন, আঙ্কারায় বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। ইসরায়েলকে আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারে বদ্ধপরিকর।

 

তিনি আরও বলেন, তুরস্ক বিশ্বাস করে, ইসরায়েল সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে এবং এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সমর্থন রয়েছে।

 

কাতারে হামলার পর তুরস্কের মধ্যে আরেকটি শঙ্কা জন্মেছে—ন্যাটো জোটের প্রতিশ্রুতি কতটা কার্যকর? কারণ, কাতার ‘মেজর নন-ন্যাটো অ্যালাই’ হলেও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো দৃশ্যমান প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি।

 

ওজকিজিলসিক বলেন, তুরস্ক বহু আগেই বুঝে গেছে, জাতীয় নিরাপত্তার জন্য শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্র বা ন্যাটোর ওপর নির্ভর করা যাবে না।

 

নেতানিয়াহুর ‘গ্রেটার ইসরায়েল’ এবং তুরস্কের উদ্বেগ

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সম্প্রতি ‘গ্রেটার ইসরায়েল’ ধারণাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেছেন। আগস্টে এক সাক্ষাৎকারে তিনি স্পষ্টভাবে বলেন অবশ্যই, আমি এই ধারণায় বিশ্বাস করি। এ মন্তব্য আঙ্কারায় কেবল প্রতীকী হিসেবেই বিবেচিত হয়নি, বরং এটিকে তুরস্কের আঞ্চলিক কৌশলের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক হিসেবে দেখা হচ্ছে।

 

তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান আল জাজিরাকে বলেন, গ্রেটার ইসরায়েলের লক্ষ্য হলো—এই অঞ্চলের দেশগুলোকে দুর্বল, অকার্যকর এবং বিভক্ত করে রাখা।

 

এই প্রেক্ষাপটে, ইসরায়েল শুধু গাজা বা পশ্চিম তীরেই নয়—সিরিয়া, ইয়েমেন, এমনকি তিউনিসিয়ায় গাজায় প্রেরিত সাহায্য বহরে হামলা চালিয়েছে। পাশাপাশি, ইরানের ওপর সামরিক হামলায় প্রবলভাবে অংশ নিয়েছে।

 

আঞ্চলিক আধিপত্য: সংঘাতের মূল রূপরেখা

ইসরায়েলকে আঞ্চলিক একচ্ছত্র শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার যে প্রবণতা, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে জুলাইয়ে, যখন যুক্তরাষ্ট্রে তুরস্কের দূত ও সিরিয়া বিষয়ক বিশেষ দূত টম ব্যারাক স্বীকার করেন—ইসরায়েল একটি ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী সিরিয়া চায় না।

 

সিরিয়ার ওপর একাধিক হামলা, লেবাননের দক্ষিণে হিজবুল্লাহ নেতৃত্বে আঘাত, এবং ইরানের সঙ্গে ১২ দিনের যুদ্ধ—সবই ইঙ্গিত দেয় যে, ইসরায়েল আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের একে একে দুর্বল করতে চাইছে।

 

পরবর্তী সংঘর্ষের ক্ষেত্র: সিরিয়া?

সাবেক তুর্কি নৌ-অ্যাডমিরাল এবং ‘ব্লু হোমল্যান্ড’ কৌশলের রূপকার সেম গুরদেনিজ বলেন, তুরস্ক ও ইসরায়েলের প্রথম সংঘর্ষের ক্ষেত্র হতে পারে সিরিয়ার স্থল ও আকাশসীমা।

 

তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ছায়ায় গ্রিস, গ্রিক সাইপ্রাস ও ইসরায়েলের সমন্বয়ে সাইপ্রাসে যে সামরিক ও গোয়েন্দা ঘাঁটি শক্তিশালী হচ্ছে, তা তুরস্কের ব্লু হোমল্যান্ড নীতিকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।

 

তুরস্ক ও ইসরায়েলের মধ্যে উত্তেজনা নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। ‘গ্রেটার ইসরায়েল’ ধারণা, কাতারে ইসরায়েলি হামলা, সিরিয়ায় আঞ্চলিক কর্তৃত্বের প্রতিযোগিতা—সব মিলিয়ে আঙ্কারার চোখে এখন ইসরায়েল একটি আগ্রাসী ও একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে পরিচালিত শক্তি। তুরস্ক, তার সামুদ্রিক ও আঞ্চলিক কৌশল নিয়ে, এই আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

 

সূত্র: আল জাজিরা।