ঢাকা শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১


বিএনপি নেতার জীবনবৃত্তান্তে ভূয়া শিক্ষাগত যোগ্যতা বানোয়াট পদ-পদব


৭ মার্চ ২০১৯ ০৭:৩২

বিএনপির এক নেতার প্রকাশিত জীবন বৃত্তান্ত দলের ভেতরে হাস্য কৌতুকের সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি লন্ডনে নির্বাসিত সাংবাদিক অলিউল্লাহ নোমান বিএনপির একজন আন্তর্জাতিক সম্পাদকের জীবন বৃত্তান্ত নিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়েছেন ফেইসবুকে। এই জীবন বৃত্তান্তটি ওই নেতা ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে বিদেশীদের কাছে পাঠিয়েছিলেন। জীবন বৃত্তান্তে তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে তাঁর কর্মজীবনের উল্লেখিত পদবী নিয়েও। প্রশ্ন উঠেছে লেবারপার্টিতে তাঁর সংশ্লিষ্টতা এবং পদবীকে কেন্দ্র করেও। জীবন বৃত্তান্তের প্রতিটি ধাপে প্রশ্নবোধক চিহ্নিত ব্যক্তিটি হঠাৎ করেই দলে এসে বড় নেতা হয়ে গেছেন! ২০১৩ সালে তিনি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান লন্ডনে চিকিৎসাধীন তারেক রহমানের কাছে ভিড়তে সক্ষম হন। নানা পথ ঘুরে তিনি একদল চাটুকারের মাধ্যমে তারেক রহমানের কাছে ভিড়েন। এর পর থেকে তাঁর বিএনপির রাজনীতি শুরু। হঠাৎ করেই তাঁর নামের পাশে লেখা শুরু হয়, তারেক রহমানের বিশেষ উপদেষ্টা। বিগত কাউন্সিলের পর তাঁকে প্রথমে ৫ নাম্বার সহ আন্তর্জাতিক সম্পাদক পদ দেয়া হয়। কিন্তু দুই সপ্তাহের মাথায় অতি গোপনে তাঁকে পদোন্নতি পান আন্তর্জাতিক সম্পাদক পদে।

আন্তর্জাতিক সম্পাদক পদ দেয়া হলেও তিনি দলের প্রতিষ্ঠাকালীন থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন পদে থাকা সিনিয়র নেতাদের কঠোর সমালোক। কথায় কথায় তিনি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানে দোহাই দিয়ে আলাপ আলোচনায় সিনিয়র নেতাদের সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করেন। সম্প্রতি লন্ডনে আইন পেশায় নিয়োজিত ব্যারিস্টার বেলায়েত একটি স্ট্যাটাসে উল্লেখ করেন দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান সম্পর্কে বাজে মন্তব্যের প্রসঙ্গটি। এর সূত্র ধরেই অলিউল্লাহ নোমান তাঁর স্ট্যাটাসে ওই আন্তর্জাতিক সম্পাদকের জীবন বৃত্তান্তে উল্লেখিত বিভিন্ন তথ্য নিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন।

জীবন বৃত্তান্তের শুরতে লেখা রয়েছে, হুমায়ূন কবীর। বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের বিশেষ উপদেষ্টা। এতে তিনি কর্মজীবনের যে বৃত্তান্ত দিয়েছেন সেখানেও রয়েছে সর্বৈব অসত্য তথ্য। শিক্ষাগত যোগ্যতায় বর্ণনায় বলা হয়েছে, তিনি পলিটিকস, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং ম্যানেজমেন্টে পড়েছেন। একই সঙ্গে ৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম উল্লেখ রয়েছে। এ গুলোর মধ্যে রয়েছে সাসেক্স, লন্ডন স্কুল অব ইকনোমিক্স এবং ক্যামব্রিজ। প্রশ্ন উঠেছে তাঁর এই শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে। তিনি আসলে কোথায় কোন সাবজেক্টে পড়েছেন এনিয়ে বিরাট প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। খোজ নিয়ে জানা গেছে, তিনি ম্যানেজমেন্টে সাসেক্স ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখা করলেও অন্য দুটি সাবজেক্টের ধারে কাছেও তিনি কখনো ছিলেন না। সম্পুর্ণ ভূয়া তথ্য তিনি উল্লেখ করেছেন পলিটিকস্ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে। সিভিতে উল্লেখিত কর্মস্থলের পদ পদবী নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। বিএনপির ভেতরে কৌতুহল শুরু হয়েছে এমন একটি বিভ্রান্তিকর ব্যক্তি কেমন করে দলে এসেই আন্তর্জাতিক সম্পাদকের পদ পেয়ে গেলেন!

কে এই হুমায়ূন কবীর?
ছোট বেলা থেকে লন্ডনে বড় হয়ে উঠা অতি সাধারণ সিলেটি প্রবাসী পরিবারে তাঁর জন্ম। পরিবারে একমাত্র তারই পড়ালেখা রয়েছে। খোজ নিয়ে জানা গেছে, পড়ালেখা শেষে এক সময় তিনি লন্ডনে লেবার পার্টির সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। লেবার পার্টির স্থানীয় ওয়ার্ড বেথনালগ্রীন ও বো শাখার সেক্রেটারি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ভবঘুরে জীবন যাপন এবং লাম্পট্যের কারনে ৬ মাসের মাথায় লেবার পার্টি তাঁকে বহিস্কার করে দেয়। অথচ, তাঁর জীবন বৃত্তান্তে তিনি উল্লেখ করেছেন লেবার পার্টির টওয়ার হ্যামলেটস্ কাউন্সিলের সেক্রেটারি ছিলেন। যেটা একেবারেই মিথ্যা। জীবন বৃত্তান্তে শিক্ষাগত যোগ্যতায় যেমন তথ্যে অসত্যের আশ্রয় নিয়েছেন, তেমনি লেবার পার্টি নিয়েও ভুয়া পদবী উল্লেখ করেছেন তিনি। তাঁর জীবন বৃত্তান্তের সূত্র ধরে খোজ নিতে গিয়ে এসব ভূয়া পদবীর সন্ধান পাওয়া গেছে।
২০১৫ সালের জানুয়ারীতে ২০ দলীয় জোটের অবরোধ আন্দোলনের সময় আমেরিকার ৬ কংগ্রেসম্যানের স্বাক্ষর জালিয়াতি নিয়ে তখন তোলপাড় হয়েছিলে। এই জালিয়াতির সময় উঠে এসেছিল তাঁর নাম। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় তখন তাঁকে দায়ী করা হয়েছিল কংগ্রেসম্যানের স্বাক্ষর জালিয়াতির জন্য। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৬ কংগ্রেসম্যানের স্বাক্ষর জালিয়াতির মূল হোতা ছিলেন হুমায়ূন কবীর। এজন্য অনেকেই তখন তাঁকে রসিকতা করে জালিয়াত উপদেষ্টা বলেও আখ্যায়িত করতেন। এমন চল চাতুরি এবং ভুয়া পদ পদবী ছাড়া তাঁর বিষয়ে খোজ নিয়ে আর তেমন কিছু পাওয়া যায় না।

২০১৮ সালের আগষ্টে ইন্ডিয়ায় গিয়ে একটি পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন হুমায়ূন কবীর। ওই পত্রিকার সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, বিএনপির পররাষ্ট্র নীতি ভুল পথে পরিচালিত ছিল। ১৯৮০ এবং ১৯৯০ দশকের (শহীদ জিয়াউ রহমান এবং বেগম খালেদা জিয়ার) ভুল পথে পরিচালিত পররাষ্ট্রনীতি জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে। এখন থেকে ইন্ডিয়ান নীতি অনুসরন করে চলার ঘোষনা দিয়েছিলেন তিনি। এনিয়ে দলের ভেতরে তখন অনেক প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনি লন্ডনে আড্ডায়, আলোচনায় বিএনপির সিনিয়র নেতাদের দল থেকে বের করে দেয়ার কথা বলেন হরহামেশা। এমনকি বিশিষ্ট প্রবীন সাংবাদিক শফিক রেহমান গ্রেফতার হয়ে কারাগারে যাওয়ার পর তিনি লন্ডনে সহকর্মীদের কাছে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছেন। দলীয় নেতাকর্মীদের কাছে তিনি প্রায়শই বলেন, আওয়ামীলীগ আগামী ৩ মাসের মধ্যে বিদায় নিবে। গত ৫ বছর জুড়ে তাঁর মুখে শুধু ৩ মাসই শুনেছেন নেতাকর্মীরা। সর্বশেষ নির্বাচনের আগে তিনি নেতাকর্মীদের নিশ্চিত করে বলেছিলেন, আওয়ামীলীগ বিদায় হয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসতেছে। লন্ডন প্রবাসী অনেক নেতাকর্মীকে জানুয়ারীর প্রথম সপ্তাহে দেশে ফেরার জন্য তৈরি থাকতেও বলেছিলেন তিনি। তাঁকে কেন্দ্র করে নারী ঘটিত অনেক ঘটনাও লন্ডনে মুখে মুখে প্রচারিত রয়েছে।

নতুন সময়/এসইউএ