ঢাকা বৃহঃস্পতিবার, ২৮শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০


ভালোবাসার অর্থ বাঁচার চেয়ে আরো বড়ো কিছু!


২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৮:০৪

চকবাজারে নিহত বর

ছেলে নর্থ সাউথে পড়ে, অনেক কষ্টের মধ্যেও সন্তানকে মানুষ করতে চেয়েছিলেন মা। আশা ছিল এইতো কয়দিন পর সন্তান সংসারের হাল ধরবে। সেই মা এখন উদভ্রান্ত,কেউ তাকে সান্তনা দিচ্ছে, কেউ বা তার দুঃখে চোখের জল মুছছে। সেই পাগলিনী মা সন্তানের গলিত এক টুকরো মাংস চাচ্ছে, আহাজারি করছেন তার অন্তিম ইচ্ছেটার জন্য।

আশেপাশের সবাই শোকে মুহ্যমান,কেউ বা স্বজন হারিয়েছেন,কেউ বা স্বজনের খোঁজে এসেছেন।কেউ এসেছেন নিজের তাগিদে মানুষের পাশে দাঁড়াতে।সবার চোখে জল।এই উন্মাদিনী মা হয়তো কেঁদে কেঁদে একদিন শোকে পাথর হয়ে যাবেন, তারপর স্বাভাবিক নিয়মে সমাজের সবাই হয়তো সব ভুলে যাবে।কিন্তু ঐ মা ? পৃথিবীতে মায়ের কষ্টটা তো অন্যরকম।

শিশুকে কোলে রেখেই আগুনে মার মৃত্যুর খবর।তবেকি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মা বাঁচাতে চেয়েছিলো তার সন্তানকে? পারেনি হয়তো ভেবেছিলো সন্তান ছাড়া বেঁচে থাকার কোন অর্থ হয় না।

চার বন্ধু আড্ডা দিচ্ছিলো।পাওয়া গেল তাদের মাথার খুলি।সবাই শক্ত সামর্থ্য।তবে কি তারা ভেবেছিলো,বাঁচলে এক সাথে বাঁচবো আলাদা ভাবে নয়।অবশেষে আগুনের কাছে হেরে গিয়ে জিতিয়ে দিলো বন্ধুত্বটাকে।পৃথিবীকে জানিয়ে দিলো তোমরা যাই বলো জেনে রেখো বন্ধুত্বটা একেবারে ফুরিয়ে যায়নি।

দুই ভাই তাদের বুকের মাঝখানে বাঁচাতে চেয়ে ছিলো প্রিয় সন্তানকে।হয়তো ভেবেছিলো আগুন তাদের দগ্ধ করলেও বেঁচে যাবে তাদের সন্তান। বাঁচাতে পারে নি ঠিকই। তারা হয়ে গেলো একটা ছবি। আগুন তবে কি তাঁদের ভস্মীভূত করতে গিয়ে থেমে গিয়েছিলো?বুঝেছিলো,মানুষের ভালোবাসার আখ্যান তার শক্তির কাছে পুরোপুরি তুচ্ছ।

গর্ভবতী স্ত্রীকে নিচে নামাতে পারেনি বলে স্বামীও নামেনি। সে হয়তো বাঁচতে পারতো, তবে কি ভেবেছিলো, যাকে ভালোবাসি তার যখন এই মৃত্যু, আমার বেঁচে থাকাটা নিরর্থক।জানিনে সে মৃত্যুর স্বরুপ কেমন দেখেছিলো।মৃত্যুর কাছাকাছি গিয়ে হয়তো উপলব্ধি করেছিলো,
ভালোবাসার অর্থ বাঁচার চেয়ে আরো বড়ো কিছু।

বাবার কাছে সন্তান বিরিয়ানী খেতে চেয়েছিলো।বাবা এসে দেখেন তার সন্তান আগুনে পুড়ছে। এই পুরান ঢাকার এক মার কাছে তার বন্দী সন্তান ভাত খেতে চেয়েছিলো।সেই সন্তানকে ভাত খাওয়াতে পারেননি বলে যতোদিন সেই মা বেঁচেছিলেন, অপেক্ষা করে গেছেন যদি সেই সন্তান ফিরে আসে। অপেক্ষার পর অপেক্ষা, মৃত্যু পর্যন্ত সেই মা আর কোনোদিন ভাত স্পর্শ করেননি। এই বাবাও কি পারবেন পুরানোঢাকার লোকদের প্রিয় বিরিয়ানী খেতে?
হয়তো সন্তানের জন্য সব বাবামায়ের উপলব্ধি ঠিক একইরকম।

মর্গে ১ বৎসরের যমজ ভাই মার কোলে খুজে ফিরছেন বাবাকে। বাবা বেঁচে নেই, তবেকি মর্গে শুয়ে আছে? এক বৎসরের শিশু সে বাবাকে চিনবে কি করে? গায়ের গন্ধে যদিও বা বুঝতো এখানতো পোড়া গন্ধের বিভৎসতা। যেদিন বড় হবে,হয়তো বাবার কথা খুব করে মনে পড়বে এই মর্গে এসে সেদিনও কি খুজবে প্রিয় বাবার মুখ?এই রকম সহস্র বেদনা,স্বজন হারানো,আর্তনাদ,দীর্ঘশ্বাস আর পোড়া মৃত্যুর মিছিল -চকবাজার চুড়িপট্রি।

নিমতলি থেকে চকবাজার একই রকমের কান্না, মৃত্যুপুরীর দুঃসহ বিভীষিকা, একই টাজেডি
একই সংবাদ শিরোনাম মাঝখানে কিছুটা সময়। আবার সেই একই তদন্ত,প্রতিশ্রুতি,ক্ষতিপূরণের আশ্বাস মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনের মূল্য কত হলে ভালো হতো?

ঢাকা যেন বসবাসের অযোগ্য এক শহর। মাঝে মাঝে সিরিয়ার দামেস্কো শহরের সাথে প্রায় সমকাতারে। অথচ এখানে যুদ্ধ নেই,মহামারি নেই,দুর্ভিক্ষ নেই,নেই কোনো সেই রকমের প্রাকৃতিক দুর্যোগ। তবেকি মানব সৃষ্ট মন্বন্তর,অব্যবস্থাপনার মারীতে আক্রান্ত? এর জন্য কে দায়ী!

যেকোনো দুর্ঘটনা স্বাভাবিক,কিন্তু ক্ষতির পরিমাণ রীতিমতো অবিশ্বাস্য। তবে কি আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি? নাকি আমরা নিরুপায়। নাকি অন্য কোন কারণ? কে দেবে এ জবাব!
আবার সেই পুরনো পথে হাঁটা।নিমতলী থেকে চক বাজার চুড়িপট্রি বিভৎসতা আর মৃত্যুর এক উপত্যকা । বস্তায় পুরে রাখা পোড়া লাশে গ্রথিত মানুষের পরিচয়। ডিএনএ টেস্ট,গলিত লাশ,মাংসপিন্ড,মাথারখুলি,পোড়া হাড় পাজরা। আর সন্তানের একটুকরো পোড়া মাংসের জন্য মায়ের কি কান্না, কি বুক ফাঁটা আর্তনাদ,কত সর্বশান্ত সংসার!আর কতো!
আমরা কি জানি,এর শেষ কোথায়?

লেখক: শেখ মঞ্জুর করিম
জিএম,রুপালী ব্যাংক লিমিটেড