ঢাকা শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৬ই চৈত্র ১৪৩০


নারীর পরিচয় কীসে? পিতা, স্বামী নাকি আপনার গুণে ! প্রসঙ্গ সংরক্ষিত নারী আসন


১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৮:১৬

যুব-মহিলা লীগ নেত্রী শিরিনা নাহার লিপি

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণের বিপুল রায় ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের পূর্ববর্তী কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ। সরকারের গত মেয়াদের বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপের ফলে জনগণের জীবন-মান উন্নয়নের অগ্রগতির হয়েছে প্রভূত এবং ঘুরেছে দেশের অর্থনীতির চাকা। যার ফলে গত ৩০ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অসামান্য বিজয় লাভ করে। এরই ধারাবাহিকতা জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে আওয়ামীলীগ আনুপাতিক হারে পায় ৪৩ টি আসন।

সংসদে নারীর জন্য ৫০ আসন সংরক্ষিত রাখা হয়েছে কারণ, এর মাধ্যমে নারীদের ক্ষমতায়ন এবং নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা। কিন্তু সম্প্রতি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে জানা যায়, আওয়ামীলীগ থেকে শিরিন নাহার লিপিকে মনোনয়ন দেয়ার পর তাঁর স্বামীর বিরোধী রাজনৈতিক আদর্শ বিবেচনায় এনে শেষ মুহূর্তে তা প্রত্যাহার করা হয়েছে। দেশ জুড়ে আলোচিত এ ঘটনা সাধারণের মনে একটি জিজ্ঞাসা তৈরি করেছে; সংরক্ষিত নারী আসন আদৌ কী নারীর ক্ষমতায়নের জন্য? নারীর আপন সত্ত্বার পরিচয় আমাদের সমাজে বা রাষ্ট্রে আলাদা ভাবে আছে কী? কোন নারী অধিকার বিষয়ক সংগঠনকেও এ নিয়ে কোন উচ্চ-বাচ্য করতে দেখা গেল না। আজ স্বামীর পরিচয়ে স্ত্রীকে রাজনীতির মাঠ থেকে দূরে নিক্ষেপ করা হয়েছে, কাল স্বামীকে স্ত্রীর পরিচয়ের কারণে একই পরিণতি ভোগ করতে হবে।

স্বামী পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রবল আধিপত্যে হয়ত টিকে যেতে পারেন। কিন্তু স্ত্রী তাঁর আজীবন দলের প্রতি একনিষ্ঠ শ্রম-ঘাম আর ত্যাগের বিনিময়ে কী পেলেন? আসলেই নারীর পরিচয় বদলেছে? পিতা নিখাঁদ আওয়ামীলীগার ছিলেন, তাঁর পরিচয় মুখ্য হবে? নাকি স্বামী জাতীয়তাবাদী আদর্শের, এটি? নাকি সব কিছু বাদ দিয়ে নারী তাঁর ব্যক্তিক কর্ম ও গুণাবলি দিয়ে? প্রশ্নগুলো আজ এই চরম অত্যাধুনিক যুগে এসেও আবার করতে হচ্ছে। বিষয়টি সত্যই ভাবনার-মস্তিষ্কক্ষয়কারক।

প্রায়দেড়শো বছর আগে নরওয়েজিয়ান নাট্যকার হেনরিক ইবসেন “এ ডলসহাউস” (১৮৭৯) নাটকে নোরা চরিত্রের মাধ্যমে নারীর আত্মপরিচয়ের সংকটকে প্রথম ইউরোপে সবার সামনে তুলে এনেছিলেন। “নোরা” আপন সত্ত্বার পরিচয়কে প্রাধান্য দিতে গিয়ে স্বামীর সংসার থেকে বের হয়ে আসে। সে সাজানো নিশ্চিন্ত সংসার-সন্তান ছেড়ে মৃদু শব্দে দরজা আটকিয়ে বেরিয়ে পড়ে অজানা পৃথিবীর উদ্দেশ্যে। ইউরোপীয় সমাজ-সংকৃতি সমালোচকগণ মনে করেন, নোরার এই মৃদু শব্দ তখনকার সময়ে পৃথিবীর বুকে কামান দাগানোর শব্দ হয়ে বেজেছিল। নোরার এই পদক্ষেপ ভবিষ্যতের নারী স্বাধীনতার পথ দেখিয়েছিল। বিশ্ব জুড়ে আজ নারীর ক্ষমতায়নের এই যে জয়জয়াকার, এর শুরুর পথ হেনরিক ইবসেনের নোরার হাত ধরে। একুশ শতকের এসে আজ ও দেখ যাচ্ছে নোরা হতে না পারার দায় বহন করতে হচ্ছে। নোরার মত সংসার ত্যাগ না করার ফলে রাজনীতির কক্ষপথ থেকে চ্যুত হতে হচ্ছে। সভ্যতা কতটুকু অগ্রসর হলে তবে!

শিরিনা নাহার লিপির রাজনৈতিক ও পারিবারিক জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পারিবারিকভাবেই তিনি আওয়ামী ভাবাদর্শ ও আবহে বেড়ে ওঠেছেন। তাঁর বাবা মরহুম এম এ বারী ছিলেন বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় খুলনা শহর থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য এবং খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। অন্যদিকে, ব্যক্তি লিপিও ছাত্রলীগের দুর্দিনের সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৮৬-৮৭ সালে শামসুন্নাহার হল ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। ১৯৮৮-৮৯ সালেএকই হলের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। ঐ সময়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের জন্য ক্যাম্পাসে রাজনীতি করা ছিল দুরুহ। প্রায় অবরুদ্ধ ও বিরুদ্ধ পরিবেশে ছেলেদের জন্য যখন ঢাবি ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি করা কঠিন হয়ে পড়ে তখন একজন নারী হয়ে সকল রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে এগিয়ে আসেন শিরিন নাহার লিপি।

বঙ্গবঙ্গুর ছাত্রলীগের আলোর মশাল হয়ে তিনি নিবেদিত একজন কর্মী হিসেবে কাজ করে গেছেন। তখনকার সমসাময়িক ছাত্রদের কাছ থেকে শোনা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯৪ সালে ছাত্র সংসদ নির্বাচন (ডাকসু) হওয়ার কথা ছিল ( যা পরবর্তী সময়ে হয়নি), তাতে ছাত্রলীগের প্যানেলে ভিপি প্রার্থী ছিলেন তিনি।তৎকালীন ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটির হল শাখার সভাপতিও ছিলেন তিনি। তাছাড়া তিনি পরপর দু’বার যুব-মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতির দায়িত্ব সফল ভাবে পালন করেন। এরশাদ বিরোধী আন্দোলন এবং ২০০১ এর পর চারদলীয় জোট সরকার বিরোধী আন্দোলনের সময়ও শিরিন নাহার লিপি সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন।

এবার আসা যাক তাঁর স্বামী অ্যাডভোকেট কামরুল হাসান সজল প্রসঙ্গে।
অ্যাডভোকেট কামরুল হাসান সজল বর্তমানে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। ছাত্রজীবনে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল প্রতিষ্ঠায় জড়িত থাকলেও ১৯৯১ সালে ছাত্রলীগে যোগদান করেন এবং ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত এ সংগঠনে সক্রিয় ছিলেন। পরবর্তীকালে বিভিন্ন দল ঘুরে পুনরায় বিএনপিতে স্থিত হন। একটি সূত্রে জানা যায়, অ্যাডভোকেট কামরুল হাসান সজল যখন ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সক্রিয় ছিলেন তখন শিরিন নাহার লিপি তাঁকে বিয়ে করেন। পরবর্তীকালে নানা পট পরিবর্তনে অ্যাডভোকেটকামরুলহাসানসজল দল বদল করলেও স্ত্রী তাঁর আদর্শে অবিচল ছিলেন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিরিন নাহার লিপির পরিবারকে নিয়ে এতো বেশি আলোচনা হয়েছে যে, মনে হয়েছে বাংলাদেশে কোন রাজনৈতিক পরিবারে আজ পর্যন্ত বুঝি আওয়ামীলীগ-বিএনপি আত্মীয়তা হয়নি। অথচ ইউটিউব বা গুগল সার্চে সহজেই জানা যাচ্ছে আওয়ামীলীগ বা বিএনপির অনেক শীর্ষ নেতা নিজেদের ছেলে বা মেয়েকে বিয়ে দিয়ে তালই-শ্বশুর বানিয়ে বসে আছেন। আত্মসমালোচনা যদি করতে হয় তবে উভয় দিকই বলা উচিত। শুধু একজনের উপর দায় চাপিয়ে তাঁর সকল ত্যাগ-সংগ্রামকে ধুলায় মিশিয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের শুদ্ধ সৈনিক হওয়ার চেষ্টার মাঝে তাই কিছু গলদ যখন কেবল একজনকেই শূলে চড়ানো হয়। বিপরীত আদর্শের লোকজনের সাথে আত্মীয়তাকে যদি বর্জন করতে হয় তবে এই নিয়ম সকলের জন্যই সমানভাবে প্রযোজ্য হওয়া উচিত।

আজকে একজন শিরিন নাহার লিপিকে বলি দেয়া হল কাদের প্ররোচনায়? দুঃসময়ের প্রকৃত কাণ্ডারীদের আজ যখন প্রতিদান দেয়ার সময় হল, তখন এর পেছনে গভীর কোন ষড়যন্ত্র লুকিয়ে আছে কী না তা ভেবে দেখা দরকার? দলে আওয়ামী ছদ্মবেশীদের হাইব্রীড নামে অভিহিত করা হয়। গণমাধ্যমে হরহামেশা অতি আওয়ামী লীগারদের ব্যাপারে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে সাবধান থাকতে বলা হয়। এমন কী, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে একবার আক্ষেপ করে বলতে শোনা যায়, তাঁকে ছাড়া সবাইকে কেনা যায়! এ কথার মর্মার্থ অনুধাবন করতে মনীষী হওয়ার প্রয়োজন নেই। হাইব্রীডদের কারণে অনেক প্রকৃত ত্যাগী নেতা-কর্মী দল ক্ষমতায় এলে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। অভিমানে তারা দূরে সরে থাকে ঠিকই কিন্তু দলের বিপদের দিনে আবারো তারা ঝাপিয়ে পড়ে। এই ত্যাগী নেতারা দল থেকে কিছু পাবার আশা করে না। অপরদিকে, বিরোধী দলের সময় হাইব্রীড অতি ভক্তদের খুঁজে পাওয়া যায় না। আজ দল যখন টানা তৃতীয় বারের মত ক্ষমতায় আসে, জননেত্রী ঠিকই দুঃসময়ের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের সঠিক মূল্যায়নে সচেষ্ঠ হন। কিন্তু স্বামীর দোষে স্ত্রীর অবদানকে অস্বীকার করে বিতর্কিত করার হীন স্বার্থ সফল করার মাধ্যমে কারা লাভবান হয়েছে? বিষয়টি নিয়ে অনেক বিতর্ক করার অবকাশ আছে; অনেক উদাহরণ দেয়া যাবে ঠিকই। তবে ব্যক্তি শিরিন নাহার লিপির দলীয় আদর্শের ব্যাপারে কেউ কোন প্রশ্ন তুলতে পারে নি। তাহলে ব্যক্তির পরিচয়কে উহ্য রেখে অন্য পরিচয়কে সামনে আনার কারণ কী?

আরেকটা বিষয় হল, নারীর ব্যক্তিসত্ত্বা বলে কী কিছু নেই? একজন নারীর পরিচয় সে কখনো কারো জায়া, কারো বা জননী; সব ছাপিয়ে সে একজন অস্তিত্বশীল মানুষ। ফরাসি দার্শনিক জ্যা পল সার্ত্র অস্তিত্ববাদ দর্শনে একজন মানুষ, কেন সে মানুষ সেটা বুঝাতে গিয়ে তিনি মানুষের নিজস্ব ভাবনাজগত ও চিন্তার স্বাতন্ত্র্যকে তুলে ধরেছিলেন। নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার না করেও কেবল ব্যক্তি মানুষকে মূল্যায়ন করলেও নারীকে তার মর্যাদা দিতে হবে। অথচ আমরা পুরুষের পরিচয়কে এখানে মুখ্য করে তুলেছি। শিরিন নাহার লিপির মূল্যায়ন তাঁর ব্যক্তিগত কর্ম দিয়ে হওয়া উচিত ছিল কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীর সংরক্ষিত আসন মনোনয়নেও নারীর পরিচয়কে হেয় করে পাশের পুরুষের পরিচয়কেই মুখ্য করেছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা একজন নারী, তাই পুরুষের পরিচয়ে একজন নারীর অবদানকে নিশ্চয় তিনি বিবেচনায় নেন না। তর্কের খাতিরেও বলা যায়, পুত্রের অপরাধের শাস্তি যেমন পিতা বহন করে না, তেমনই স্বামীর ভিন্ন আদর্শদের দায়ও স্ত্রীর নিতে পারে না। প্রত্যেকে নিজের অবস্থানে স্বতন্ত্র ও স্বকীয়। আশা করি, দল অচিরেই শিরিন নাহার লিপির বিষয়ে অবস্থান স্পষ্ট করবে এবং তাঁকে তাঁর প্রাপ্য মূল্যায়ন দেবে। মনে রাখতে হবে, নারী তাঁর পিতা, স্বামীর পরিচয়ে পরিচিতি লাভ করে বটে, তবে সবচেয়ে জরুরি তাঁর ব্যক্তিক কর্ম ও গুণ।

লেখকঃ শেখ মাশরিক হাসান, সহকারী অধ্যাপক, ফিন্যান্স বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ও পিএইচডি গবেষকএডিনবার্গ নেপিয়ার ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য; E-mail:masrick.hasan@gmail.com
এবং
শাহ মো আরিফুল আবেদ, সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়; e-mail: arifulabed@yahoo.com