ঢাকা শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৬ই চৈত্র ১৪৩০


তাহলে কেন সড়ক এখনো মৃত্যুফাঁদ


১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৭:০৫

প্রতিকি

একটি দুর্ঘটনা সারাজীবনের কান্না। একটি দুর্ঘটনার ফল একটি পরিবারকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয়। একটি দুর্ঘটনায় নিঃস্ব হয়ে যায় অনেক পরিবার। অনেকেই হারায় তাদের প্রিয়জনদের। আবার অকালেই ধূলিসাৎ হয়ে যায় হাজারো স্বপ্ন। খালি হচ্ছে হাজারো মায়ের কোল। কেউবা হারাচ্ছে সংসারের একমাত্র উপার্জক্ষম ব্যক্তিকে। আর কেউবা পঙ্গু হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এর কোনোটিই আমাদের কাম্য নয়। কিন্তু আমাদের দেশের চিত্র এই মর্মান্তিক বিষয়গুলো মেনে নিতে বাধ্য করে। প্রতিদিনের খবরেরকাগজ খুললেই স্তম্ভিত হতে হয়। বিভিন্ন খবরেরকাগজে দেশের নানা অঞ্চলের সড়ক দুর্ঘটনার লোমহর্ষক নানা খবর, যেখানে প্রতিদিনই হতাহতের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। এমন একটি দিনও আমাদের আসে না যেদিনটায় সারা দেশে কোনো সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে না।

দেশের যাতায়াত ব্যবস্থায় অন্যান্য পথে যুগান্তকারী উন্নতি সাধিত হলেও সড়কপথ যেন মৃত্যুফাঁদ। আমাদের দেশের সড়ক কারো জন্যই নিরাপদ নয়। এমনকি সড়কের পাশের বাড়িগুলোতেও মানুষ শান্তিমতো ঘুমাতে পারে না। কখন যে-কোনো গাড়ি এসে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। সড়কগুলোতে নিরাপদে কেউ হাঁটতে পারে না। ভয়ে যাতায়াত করতে পারে না ছোট ছোট যানবাহনগুলোতে। উঠলে মনে হয় এই বুঝি কোনো বাস বা ট্রাক চাপা দিয়ে দেয়। মানুষ যতক্ষণ রাস্তায় থাকে ততক্ষণ তারা জীবনের আশা করে না।

আজ বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে উন্নয়নের রোল মডেল। তাহলে আমাদের দেশের মানুষ কেন নিরাপদে একটু চলাচল করতে পারবে না? আর কত প্রাণ ঝরবে সড়কের বুকে? আর কত সন্তান পিতৃহারা হবে? আর কত মায়ের বুক খালি হবে? এর শেষ কোথায়? দেশে নতুন আইন প্রণয়ন করা হলেও এর প্রয়োগ কোথায়? যত্রতত্র ফিটনেসবিহীন গাড়ি বিনা বাধায় চলছে। চালকরা বেপরোয়া গতিতে প্রতিযোগিতা করে গাড়ি চালাচ্ছে, সামনে থাকা গাড়িকে ওভারটেক করতে না পারলে যেন তাদের শান্তি নেই। তাদের মানসিকতাটাই এমন। চালকদের অধিকাংশই মাদকাসক্ত। অনেকের লাইসেন্স নাই। অনেক চালক আবার অপ্রাপ্তবয়স্ক। তাহলে এত কঠোর আইন করে কী লাভ হলো?

পরিসংখ্যান বলছে বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩৫টি ছোট-বড় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে এবং প্রতিদিন সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন প্রায় ২০ জন।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, গত বছর সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ৫৪৩১। সেইসঙ্গে আহত হয়েছেন সাত হাজার ৩৭৯ জন। অপরদিকে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর মতে, গত বছর সারা দেশে মোট সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা চার হাজার ৯৬৯ এবং আহত হয়েছে পাঁচ হাজার ৮৫ জন।

বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত ‘ডেলিভারিং রোড সেফটি ইন বাংলাদেশ : লিডারশিপ প্রায়রিটিস অ্যান্ড ইনিশিয়েটিভস টু ২০৩০’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে মৃত্যুর হার অনেকাংশেই দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছে গেছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, এখনো আমাদের দেশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ঘুম ভাঙছে না। আর কত রেকর্ড হলে এ সমস্যা সমাধানে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে?

বস্তুত প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও এরকম মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। ফলে প্রতিনিয়তই সড়কে প্রাণহানির ঘটনা বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা যেন এক মহামারী রূপ নিয়েছে। তাই সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতে বাংলাদেশের সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আমাদের দেশে বিপুল পরিমাণ ফিটনেসবিহীন গাড়ি আছে, যেগুলো চালাচ্ছেন কোনো লাইসেন্সবিহীন চালক। ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে দুর্ঘটনা। ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলো তুলে নিয়ে টেকসই ও নিরাপদ যানবাহনের ব্যবস্থা করতে হবে। মূলত চালকদের অদক্ষতার জন্যই দেশের সিংহভাগ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। অনেক সময় দেখা যায় চালকের সহকারী গাড়ি চালাচ্ছেন। ফলে দুর্ঘটনার সংখ্যা বহুলাংশে বেড়ে যায়। সেজন্য তাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করে পর্যাপ্ত দক্ষ চালক তৈরি করতে হবে। সেইসঙ্গে কীভাবে তাদের মানবিক বোধোদয় করা যায় তার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শহরগুলোতে একটি নির্দিষ্ট গতিতে যান চলাচলের বিধি আরোপ করা। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের রাস্তাগুলো যথেষ্ট প্রশস্ত করতে হবে। পাশাপাশি মহাসড়কগুলোর গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে।

আমাদের এই ছোট্ট দেশটিতে আমরা চাই শান্তিতে বাঁচতে। চাই একটু নিরাপদে চলাফেরা করতে। তাই আমরা এ বিষয়ে আর জ্ঞানগর্ভ কোনো আলোচনা শুনতে চাই না। আমরা চাই এর প্রতিকার। এখনই সময় সড়ক দুর্ঘটনা রোধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের। নইলে সড়কে অকালেই ঝরে পড়বে আরো হাজারো প্রাণ। তাই সড়ক দুর্ঘটনার রোধে চিহ্নিত সমস্যাগুলো সমাধানে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অতি দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আর এতে যেন কোনোভাবেই অনিয়ম-দুর্নীতি না হয় সেদিকে কঠোর নজর দিতে হবে। তবে আমরা যাই বলি না কেন আর এ সমস্যা সমাধানে যত মহাপরিকল্পনাই গ্রহণ করা হোক না কেন, সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে যদি দুর্নীতি রোধ করা না যায় তাহলে কাঙ্ক্ষিত ফল মিলবে না।

লেখক : শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।