ঢাকা শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১


একটি নাকফুল ও একটি অজ্ঞাত মৃত্যুর রহস্য


১০ নভেম্বর ২০২০ ১৯:১৯

সংগৃহিত

একজন মহিলা ছাগল চড়াতে গিয়ে মাঠের মধ্যে মরে পড়ে ছিল। এলাকার সবার পাশাপাশি মহিলার বাবা-মাও বলছে স্ট্রোক করে মরেছে, কোন সন্দেহ নাই। তবুও পুলিশ বলছে লাশ কাটাছেঁড়া করা লাগবে। কি দরকার ছিল পুলিশের এতো বাড়াবাড়ি করার!

ঘটনাটা খুলেই বলি।

২০১৯ সালের নভেম্বর মাসের ১ তারিখ। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতেই ফুলবাড়ি থানার সেকেন্ড অফিসার এস আই জিয়ার ফোন -"স্যার একটা অপমৃত্যু হইছে। ফুলবাড়ি থানার পিছনে কাটাবাড়ি এলাকায় ধানক্ষেতে একটা মহিলার লাশ পাওয়া গেছে।"

আমি বললাম - কি হয়েছিল?

জিয়ার জবাব-" দুপুরে খাবার পর বাড়ির পাশের ধানক্ষেতে ছাগল চড়াতে গিয়েছিল মহিলা। সন্ধ্যার সময় ছাগলগুলি বাড়ি ফিরে এসেছে কিন্তু মহিলা আসে নাই। পরে তার ভাবী, ভাই আর বাবা তাকে খুঁজতে বের হয়। খুঁজতে গিয়ে দেখে শ্যালো মেশিনের ড্রেনের মধ্যে উপুড় হয়ে পড়ে আছে মহিলা। সাথে সাথেই হাসপাতালে নিয়েছিলো তারা। কিন্তু, শেষ রক্ষা হয়নি।"

আমি বললাম- তাহলে তো আর কিছুই বলার নাই। পরিবার পরিজন কি বলে?
এস আই জিয়া বললেন- "তারা বিনা ময়না তদন্তে লাশ চান। তাদের কোন অভিযোগ নাই। শরীরে দৃশ্যমান কোন আঘাত বা হত্যার আলামতও নাই।"

আমি বললাম - তাহলে জিডি করে লাশ দিয়ে দিলেই তো হয়।

কিন্তু জিয়া এমনিতে লাশ দিতে নারাজ। তার বক্তব্য “২৭/২৮ বছরের শক্ত সামর্থ্য একটা মহিলা দিনে দুপুরে হঠাৎ ক্যামন করে মারা যায়, জানা দরকার। এর মধ্যে কোনো রহস্য আছে।"

পুলিশ লাশ না দিয়ে থানায় নিয়ে এল। মহিলার মা মোমেনা বেগম (ছদ্মনাম) বাদী হয়ে অপমৃত্যু মামলার এজাহার দিলেন।

রাতে লাশ দেখতে গেলাম। লাশ দেখে মনে হলো মহিলা যেন ঘুমাচ্ছে। কোন অস্বাভাবিক কিছুই নাই। হঠাৎ খেয়াল করে দেখি মহিলার নাকের কাছে হালকা আঁচড়ের মত একটা দাগ। এস আই জিয়া বললেন - কেউ হয়তো নাকফুল খুলে নেওয়ার সময় আঁচড় লেগেছে। আমি ভালোভাবে খোঁজ নিতে বললাম, কে নিয়েছে নাকফুল, জানা দরকার। জানা গেল কেউই এ বিষয়ে কিছুই জানেন না।

এ থেকে মনের মধ্যে খটকা লাগা শুরু হলো। কিন্তু, কিছুই বের করা গেল না। পরদিন যথারীতি লাশ পোস্টমর্টেম হল। লাশ বিনা ময়না তদন্তে হস্তান্তর না করায় অনেকেই পুলিশের প্রতি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন। পুলিশ এতটা বাড়াবাড়ি না করলেও পারতো বলে অভিমত দিলেন। কিন্তু, এস আই জিয়ার কোন বিকার নাই। অভিজ্ঞ সাব ইন্সপেক্টর তিনি। স্বল্পসময়ের মধ্যেই ভিকটিমের ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য সংগ্রহ করে ফেললেন।

জানা গেল মহিলার নাম হালিমা (ছদ্মনাম)। বিবাহিতা। সপ্তম শ্রেণী পড়ুয়া তার একটা মেয়েও আছে। স্বামী আনিসুর রহমান (ছদ্মনাম)। সুনির্দিষ্ট কোন পেশা নেই। মাছ বিক্রি, দিন মজুরি করে সংসার চলে। অভাবের সংসার।

অতঃপর বিশদভাবে জানতে আমি ও জিয়া পুনরায় মৃতার বাড়িতে গেলাম। গিয়ে দেখি, অভাবের সংসার হলেও ঘরটা বেশ পরিপাটি। কিছু সৌখিন আসবাবও রয়েছে ঘরে। জানা গেল স্বামী নয়, হালিমাই এসব কিনেছে। যার আয় নাই, রোজগার নাই সে কিভাবে এত কিছু কিনলো? মনে প্রশ্ন জাগতে শুরু করলো।

বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা শুরু হল। খবর নিয়ে জানা গেল, হালিমার বেশ কটা ছাগল রয়েছে। এই ছাগলগুলিই তার আয়ের উৎস। স্বামী তেমন কিছু করে না বলে সেই সংসার চালাতো। হালিমার সাথে অনেক মানুষের পরিচয় ছিল। সে কোথায় যেত, কি করতো এ বিষয়ে পরিবারের কারও তেমন মাথা ব্যথা ছিল না। সে নিয়মিতই মাঠে ছাগল চড়াতে যেত।

আমাদের বার বার হালিমাদের বাড়িতে যাওয়াটা কেউই পছন্দ করছিলেন না। তার বাবা সাফ জানিয়ে দিলেন -মেয়েটা হয় স্ট্রোক করে মরেছে, নয়তো ভূতে মেরেছে। আমরা যেন খামোখা তাদের বিরক্ত না করি। এমনকি হালিমার ফোন নম্বর চাইলেও তারা দিতে পারলেন না বা দেয়ার আগ্রহ বোধ করলেন না। এমন পরিস্থিতিতে আমরাও তাদের বেশি বিরক্ত করতে স্বস্তি পাচ্ছিলাম না।

এর মধ্যে কেটে গেল বেশ ক'মাস। সবাই ধরেই নিল স্ট্রোক বা হার্ট এটাক এর মত কোন কারণেই মৃত্যু হয়েছে হালিমার। হঠাৎ একদিন পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট হাতে এলো। জানা গেল, শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে মহিলাকে। আবার শুরু হল তোড়জোড়। কিন্তু, কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। আমরা সবাই হাল ছেড়ে দিলাম। কিন্তু, হাল হাড়লো না দুইটা লোক। এক হল সাব ইন্সপেক্টর জিয়া আর এক হল ফুলবাড়ি থানার পুলিশ পরিদর্শক তদন্ত মাহমুদুল হাসান।

তারা হালিমার পরিবারের সবার ফোনগুলোর কল লিস্ট নিতে থাকলেন। প্রায় ৫০/৬০ টা কল লিস্টের বিশ্লেষণ শেষে আবিষ্কার হল - হালিমা গোপনে কোন একটা ফোন ব্যবহার করতো। তবে সেই ফোন কোথায় গেল?

আবার শুরু হল খোঁজাখোঁজি। দেখা গেল হালিমার ব্যবহৃত মোবাইল সেটটা গাজীপুরে ব্যবহার হচ্ছে। এর মধ্যে এসে গেল করোনা। একেবারে বাড়া ভাতে ছাই পড়ার মত অবস্থা। তবে হঠাৎ ৯ মাস পর একদিন ফোনের অবস্থান ফুলবাড়িতে দেখা গেল। কৌশলে ডেকে আনা হল ফোন ব্যবহারকারীকে। ব্যবহারকারীর নাম মজিদ (ছদ্মনাম)। ইট ভাটার শ্রমিক। তাকে আনার পর হলাম মহা হতাশ। ফোনটা নাকি তার শ্বশুর গিফট করেছে তাকে।

আনা হল মজিদের শ্বশুরকে। শ্বশুর নিতান্তই সাদাসিধা মানুষ। নাম তার খালেক (ছদ্মনাম)। তিনি জানালেন, ফোন কিনেছেন পুরাতন ফোন বিক্রেতার কাছ থেকে। ফোন বিক্রেতাকে ডেকে আনা হল। পুরাতন ফোন বিক্রেতা বললেন, প্রায় এক বছর আগের কথা। কার কাছ থেকে তিনি কিনেছিলেন তা তিনি কিভাবে বলবেন? তাছাড়া এই সেট তিনিই বিক্রি করেছিলেন কিনা সেটাও মনে নাই। ঘটনা এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত।

ভগ্ন হৃদয়ে ফোন বিক্রেতাকে যখন বিদায় দেবো তখন ফোন বিক্রেতা বললেন -" স্যার ফোনটা একটু হাতে দেন। আমি যে ফোন বেচি দেখলে চিনতে পারি।" ফোনটা হাতে নিয়ে ২/১ মিনিট দেখেই বললেন এই ফোন আমি বেচি নাই। কেননা এর স্ক্রুর উপর স্টিকার লাগানো। মানে এই ফোন এক বারও খোলা হয় নাই। আমি যেসব ফোন বেচি সেগুলো সাধারণত নষ্ট থাকে। আমি খুলে পার্টস বদলিয়ে তারপর বেচি। এটা আমার দোকানের না। এই কথা শুনে মজিদের শ্বশুর (খালেক) মহা রেগে গেলেন।

খালেকের এমন অযাচিত আচরণে আমাদের মনে হলো সে যেন কিছু লুকানোর চেষ্টা করছে। এমন সময় হঠাৎ মাথায় চিন্তা আসল - যেহেতু হালিমার নাকফুল মিসিং ছিল, অতএব সেটা হত্যাকারী নিয়ে থাকলে আশে পাশেই কোথাও বেচে থাকবে।

প্রথমেই খোঁজ নিলাম মজিদের শ্বশুর খালেকের সাথে কোন স্বর্ণকারের ভাব আছে কিনা। জানা গেল এক জনের সাথে তার বেশ খাতির। এরপর সেখানে লোক পাঠনো হল। প্রথমে স্বর্ণকার অস্বীকার করলেও পরে নানামুখী জেরায় মুখ খুললেন। জানা গেল প্রায় এক বছর আগে খালেক তার দোকানে নাকফুল জাতীয় কিছু বেচতে গিয়েছিল। কিন্তু, শেষমেষ দামে না মেলায় বিক্রি করে নাই।

এরপর ডেকে আনা হল খালেকের স্ত্রীকে। তিনি নিতান্তই সহজ সরল মহিলা। চা নাস্তা করিয়ে শুনে নিলাম খালেকের ইতিবৃত্ত । জানা গেল, এই লোক মহা বদমেজাজী। কোন কাজ করেনা। শুধু ফুটানি করে বেড়ায়। বহু বছর পূর্বে এক স্কুলছাত্রীকে উত্যক্ত করায় হাজত খেটেছে ১৪ দিন। গোপনে আরও ২/৩ টা বিয়ে করেছে। মেয়ে দেখলেই তার মাথা ঠিক থাকে না। সে তার বউকে কোনদিন গহনা কিনেই দেয় নাই, তাই বউয়ের কোন গহনা বিক্রির প্রশ্নই আসে না।

খালেকের স্ত্রীর নিকট হতে আরও জানা গেল- বছর খানেক আগে খালেক এক দিন সন্ধ্যায় গায়ে পায়ে কাদা মাখা অবস্থায় বাড়ি ফিরেছিল। এরপর ৪/৫ দিন ঘরের বাইরে যায়নি। জ্বর না থাকলেও বলেছে তার জ্বর এসেছে। বিষয়গুলি অশুভ কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছিল।

এ সব কিছু একত্রিত করে পুনরায় খালেককে জিজ্ঞেসাবাদ শুরু হল। এই লোকও নাছোড়বান্দা । হারতে নারাজ। কিন্তু, পুলিশ পরিদর্শক তদন্ত মাহামুদুল সাহেব আর ওসি ফখরুল সাহেবের জেরার মুখে অবশেষে তিনি স্বীকার করেন যে, হালিমাকে তিনিই খুন করেছেন।

মূলত হালিমার সাথে ছিল তার পরকিয়া প্রেমের সম্পর্ক। ঘটনার প্রায় তিন মাস আগে ফোনের মাধ্যমে পরিচয় হয় তাদের। এই তিন মাস ধরে ছাগল চড়ানোর জন্য মাঠে গিয়ে সুবিধাজনক জায়গা খুঁজে নিয়ে বহুবার তারা মেলামেশা করেছেন।

ঘটনার দিনও ভালই যাচ্ছিল সবকিছু। কিন্তু, ঐদিন মেলামেশার পর হালিমা তাকে বিয়ে করার জন্য চাপ দিতে থাকে। কিন্তু, তিনি রাজি না হওয়ায় হালিমা তাকে গালি দেয় এবং সব ফাঁস করে দেবার হুমকি দেয়। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে রাগ সামলাতে না পেরে হালিমার গলা টিপে ধরেন তিনি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হালিমার মৃত্যু ঘটে। এতে ভয় পেয়ে যান তিনি। এরপর খালেক দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।

এভাবেই পুলিশের বাড়াবাড়িতে একটি অজ্ঞাত মৃত্যুর রহস্য উন্মোচিত হলো।

মিয়া মোহাম্মদ আশিস বিন হাছান
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার
ফুলবাড়ি সার্কেল, দিনাজপুর।