ঢাকা শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৬ই চৈত্র ১৪৩০


কৃষি, কৃষক এবং আমাদের বঙ্গবন্ধু


১৫ আগস্ট ২০২০ ০৪:৫৮

কৃষিবিদ শাহ্ কিবরিয়া মাহবুব তন্ময়

সময়ের পালাক্রমে আবার এলো আগস্ট মাস। আক্ষরিক অর্থে এটি শুধু একটি মাসেরই নাম, তবে অন্তর্গত নিরীক্ষার হিসেবে এই মাসটি বাঙালির কাছে একটি তীব্র যন্ত্রণা এবং হৃদয়ের কুঠুরীতে অবিরত রক্ত ক্ষরণের মাস। এই আগস্টের ১৫ তারিখেই বাঙালি জাতি হারিয়ে ছিলো বাংলার আকাশের সবথেকে উজ্জ্বল নক্ষত্র জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। যেই স্বাধীনতার জন্যে বঙ্গবন্ধুকে সারাটা জীবন আন্দোলন, সংগ্রাম এবং জেলখানার অন্ধকার প্রকোষ্টে দিন কাটাতে হয়েছিলো, সেই স্বাধীন দেশেই তাঁর সেনাবাহিনীর বিপথগামী কিছু সদস্যদের হাতে তাকে সপরিবারে প্রাণ দিতে হয়েছিলো। বাংলার মানচিত্রে যোগ হলো একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। যেই কলঙ্ক থেকে আজও আমরা মুক্ত হতে পারিনি।

বঙ্গবন্ধুর মেধা, মনন ও চিন্তায় সবসময় ছিলো কৃষিকে প্রধান্য দিয়ে বাংলাদেশের উন্নয়ন। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলায় তিনি দেখতে চেয়েছিলেন দেশের কৃষি ও কৃষকের সর্বাঙ্গীন উন্নয়ন এবং স্বনিভর্রতা। বঙ্গবন্ধুর সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের পুরো দায়িত্ব এখন আমাদের সবার। কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে ক্ষুধা, অপুষ্টি ও দারিদ্র্য বিমোচনের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি সুদৃঢ় করাই হোক আমাদের চলমান অঙ্গীকার। সুতরাং আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, কৃষিই হচ্ছে আমাদের এ অঙ্গীকার পূরণের প্রধান বাহন।

১৯৭৩ সালে ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহে বঙ্গবন্ধু বিশেষ ভাষণ দিয়েছিলেন। সে ভাষণে তিনি কৃষি বিপ্লবের কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন গ্রামের দিকে নজর দিতে হবে। কেননা গ্রামই সব উন্নয়নের মূল কেন্দ্র। গ্রামের উন্নয়ন আর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি যখন বেগবান হবে তখন গোটা বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে সম্মুখপানে। তাঁর অদম্য ইচ্ছা ছিল-যেকোন উপায়ে কৃষকের স্বার্থরক্ষা করা। কেননা কৃষকই এদেশের আসল নায়ক যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আমাদের সবার অন্ন জোগায়। কৃষকের চলমান চাহিদা যথোপযুক্তভাবে নিশ্চিত করতে পারলে কৃষক অনেক আগ্রহে স্বতঃস্ফূর্ততায় কৃষিতে নিজেকে বিনিয়োগ করতে পারবে, উন্নয়নের জোয়ার বইবে। কৃষকের উন্নয়ন হলে দেশের উন্নয়ন সময়ের ব্যাপার। বঙ্গবন্ধু ভাবতেন এতোদিন আমরা শোষণে নিষ্পেষণে আমাদের মেধা প্রতিভাকে কাজে লাগাতে পারিনি, এখন সময় এসেছে নিজেদের দেশে নিজেদের জ্ঞান মেধা দক্ষতাকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর। আমরা তখন গর্বের সাথে বলতে পারবো-এই তো আমার স্বনির্ভর সোনার বাংলাদেশ। তাইতো সেদিন তিনি কৃষিবিদদের ক্লাস ওয়ান পদমর্যাদায় ভূষিত করলেন। বঙ্গবন্ধু খুব ভালো করে জানতেন মানুষের উপর জোর করে কিছু চাপিয়ে দেয়া যাবেনা, তাই তো তিনি বলেছেন- করে দেখাতে হবে, এতে কৃষক নিজে নিজে শিখে নিজের আঙিনায় বাস্তবায়ন করবে। এক গ্রামের ২০ জনকে একসাথে ক্ষেত-খামারে হাতেকলমে কাজ দেখালে পাশের অন্য কৃষক দেখে দেখে নিজের জমিতে বাস্তবায়ন করলে উৎপাদন বেড়ে যাবে। তখন সারা বাংলার অন্যরা এগিয়ে আসবে, সম্পৃক্ত হবে উন্নয়নের মূলধারায়। কেননা আমাদের কৃষক দেখে বিশ্বাস করতে অভ্যস্ত। বঙ্গবন্ধু কৃষিবিদদের বলেছিলেন, গ্রামে গিয়ে কৃষকদের সাথে কৃষকের মতো মিশে গিয়ে তাদের মনের কথা শোনা ও বুঝার জন্যে। তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন গ্রাম উন্নত হলে, দেশ উন্নত হবে, আর দেশ উন্নত হলে জাতি উন্নত হবে। আর দেশের সার্বিক উন্নয়ন নির্ভর করবে গ্রামীণ অর্থনীতির উপর। আর গ্রামীণ অর্থনীতির চালিকা শক্তি হচ্ছে কৃষক। তাই কৃষিবিদদের তিনি গ্রামীণ অর্থনীতিতে ঝাপিয়ে পড়তে বলেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু কৃষির দূরদর্শিতাকে অসামান্য পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। এ কারণেই তিনি কৃষিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন, পুনঃসংস্কার, উন্নয়ন এবং ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, উদ্যান উন্নয়ন বোর্ড, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি, ইক্ষু গবেষণা প্রতিষ্ঠান, মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনসহ অনেক নতুন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেন। কৃষিশিক্ষা, মানসম্মত বীজ উৎপাদন এবং বিতরণ, সুষ্ঠু সার ও সেচ ব্যবস্থাপনা, কৃষিতে ভর্তুকি, বালাই ব্যবস্থাপনা, সমন্বিত ফসল ব্যবস্থাপনা, খামারভিত্তিক ফসল ব্যবস্থাপনা, সমবায়ভিত্তিক চাষাবাদ, ভেঙে যাওয়া অর্থনীতি পুনর্গঠন, মিল্কভিটা পুনর্গঠন, সার, সেচ, বীজ বিষয়ক কার্যক্রম এসবের ওপর সর্বাত্মক জোর দিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত স্বপ্নগুলো উনারই কন্যার হাত ধরে এখন বাস্তবায়ন হচ্ছে। সার-কীটনাশকের দাবিতে কৃষকের মিছিলে পুলিশ গুলি করে পাখির মতো নিষ্পাপ মানুষকে হত্যা করে। এটা কোনো কাল্পনিক ঘটনা নয়, এটা এই বাংলাদেশে নব্বইয়ের দশকে বিএনপির শাসনামলের ঘটনা। এই ঘটনায় কৃষকের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে, তাদের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হতে হয়েছে তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। প্রতিবাদ আর সান্ত¡না দেওয়া ছাড়া কিছুই করতে পারেননি তখন তিনি। শাসকের বুলেটের গুলিতে শুধুমাত্র ১৭ জন কৃষকই প্রাণ হারাননি, সার না পেয়ে মাঠ হয়েছে ফসল শূন্য। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান বললেন কৃষিতে ভর্তুকি দিয়ে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলে আর বিদেশি সাহায্য পাওয়া যাবে না। উন্নয়ন ব্যয়ও নাকি মেটানো যাবে না। অর্থাৎ দেশের মধ্যেই একটা গোষ্ঠী এদেশের দরিদ্রতম মানুষকে আজীবন দরিদ্র করে রাখার কৌশলকে বেছে নিয়েছেন। শুধু একজনই এগিয়ে এসেছেন দশকের পর দশক চলে আসা এই অন্যায় আর শোষকের শোষণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে, তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। মাত্র ১০ টাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার ব্যবস্থা করে দিয়ে বর্গা চাষীদের ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করলেন। এক রেনেসাঁর অভ্যুদয় হলো নীরবে-নিভৃতে। সকলের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন কৃষকরা এদেশের ধনীদের মতো ঋণ খেলাপী নয়। কৃষকরাও জননেত্রী শেখ হাসিনার আস্থার প্রতিদান দিতে দেরী করেনি, উপহার দিলো সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা ফসলের মাঠ। খাদ্য ঘাটতির দেশ থেকে বাংলাদেশ এখন খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশ।

করোনার এই ক্রান্তি কালে দেশের অর্থনীতি যখন চড়াই উতরাই পার করছে, তখন আবার দেশরতœ আস্থা রাখলেন কৃষকদের উপর। প্রধানমন্ত্রীর ডাকে সাড়া দিয়ে কৃষকরা ঝাপিয়ে পড়লেন প্রতি ইঞ্চি জমিতে ফসল ফলানোর কাজে। দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এই যাত্রাতেও কৃষি তথা কৃষকের উপর ভর করে অর্থনীতি আবার ঘুরে দাঁড়াবে। আসুন আমরা মেধা, মনন এবং নিজেদের ঐকান্তিক ইচ্ছায় শেখ হাসিনার মাধ্যমে কৃষি এবং কৃষক নিয়ে বঙ্গবন্ধুর লালিত স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন করি। তাহলে আমরা আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি স্বনির্ভর বাংলাদেশ রেখে যেতে পারবো, ঠিক যেই বাংলাদেশের স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন। জাতি হিসেবে আমাদের তাহলে কিছুটা হলেও দায়মুক্তি হবে।

কৃষিবিদ শাহ্ কিবরিয়া মাহবুব তন্ময়
সহকারী প্রকৌশলী, বিএডিসি, সিংড়া জোন