ঢাকা মঙ্গলবার, ১৬ই এপ্রিল ২০২৪, ৪ঠা বৈশাখ ১৪৩১


বন্ধু যখন বন্ধুর খুনি


৬ মার্চ ২০২০ ১৯:১৯

ছবি সংগৃহীত

সত্তুরোর্ধ্ব বৃদ্ধা মনোয়ারা বেগমের কোন সন্তান নেই। আলীম নামে যে ছেলেটিকে তিনি পালন করতেন তিনি তার ঔরষজাত সন্তান নয়। একসময় আলীম চলে যায় তাকে ফেলে মানিকগঞ্জ সদরের লেমুবাড়ি পুটাইল এলাকায়। মনোয়ার থাকেন তার স্বামীর ভিটা সিঙ্গাইর থানার রাজেন্দ্রপুর গ্রামে। আলীমের একমাত্র পুত্র আলিফ যখন তার বাবার সাথে বিরোধ করে চলে আসে তখন তার বয়স ২০ বছর। বৃদ্ধা মনোয়ারা বেগমের একমাত্র অবলম্বন হয় আলিফ। স্বামীকে হারিয়েছেন অনেক আগেই। তাইতো অনেক আদরে আলিফের দায়িত্ব নেন দাদি। নিজে ঠিকমত খেতে না পারলেও আলিফকে কখনও না খাইয়ে রাখতেন না। সেই আলিফ যখন নিখোঁজ হয় তখন দাদি মনোয়ারা বেগম পাগলপ্রায়। আলিফের মোবাইলও বন্ধ। আলিফকে খুঁজতে খাওয়া-দাওয়া ভুলে যান দাদি। খবর পেয়ে আলিফের বাবাও খুঁজতে থাকেন ছেলেকে। ঢাকায় একটা চাকুরিতে গিয়েছিল আলিফ। মাঝে দাদির সাথে কথাও হয়েছে কয়েকবার, তবে অফিসের ঠিকানা জানতেন না। মোবাইল বন্ধ থাকায় আলিফের সাথে সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

আলিফের ফুফা ইসমাইল হোসেন। তিনিও খোঁজ নিতে থাকেন। একসময় একটি লিফলেট চোখে পড়ে তাদের। সিঙ্গাইর থানা থেকে একটি অজ্ঞাত পোড়া লাশের পরিচয় জানতে লিফলেটটি বিভিন্ন স্থানে টাঙ্গিয়েছেন। ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ তারা ছুটে যান মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতালের মর্গে। ডোমের নিকট থেকে জানতে পারেন সিঙ্গাইর থানা থেকে এ লাশটি এসেছিল চারদিন আগে। সে একটি ছবি তুলে রেখেছিল তার মোবাইলে। সেটি দেখে কিছুটা অনুমান হয় তাদের। পুরো শরীর পোড়া ও বিকৃত ছিল লাশের। দ্রুত ছুটে যান সিঙ্গাইর থানায়। এসআই আনোয়ার হোসেনের নিকট ছবি এবং লাশের হাতের আঙ্গুলে থাকা আংটি, পায়ে থাকা রাবারের চুরি ও পরনের প্যান্টের অংশ দেখে সনাক্ত করেন সেটি ছিল আলিফের লাশ। মূহুর্তে থানার পরিবেশ আচ্ছন্ন হয় শোকের মাতমে। কান্নার আওয়াজ ভেসে চলে যায় আশপাশের মানুষের নিকট। ছুটে আসেন পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা, ছুটে আসেন আত্মীয়-স্বজন।

১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ তারিখ। সিঙ্গাইর থানার চর গোড়লা এলাকার চকের মধ্যে পাওয়া যায় অজ্ঞাতনামা একটি বিভৎস পোড়া লাশ। সিঙ্গাইর থানার মামলা নং- ১৪, তারিখ- ১৮/০২/২০২০ খ্রি., ধারা- ৩০২/২০১/৩৪ পেনাল কোড রুজু হয় অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে। তদন্তকারী অফিসার এসআই আনোয়ার হোসেন পোড়া লাশের ছবি লিফলেট আকারে বিভিন্ন স্থানে প্রচার করেন। ময়না তদন্ত শেষে মানিকগঞ্জ একটি কবরস্থানে দাফন করা হয়। লাশের পরিচয় উদঘাটন হওয়ার পর পাওয়া যায় ভিকটিমের ব্যবহৃত মোবাইল নম্বর। সে সূত্রে তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় উদঘাটিত হয় ঘটনার মূল রহস্য। ২৮ ফেব্রুয়ারি সূত্রাপুরের ওয়াল্টার রোড এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় আসামি ইমরান ওরফে বিশু(২১), পিতা- জামাল মোল্লা, সাং- চড় গোলড়া, থানা- সিংগাইর, জেলা- মানিকগঞ্জকে। জিজ্ঞাসাবাদে বের হয়ে আসে ঘটনার আদ্যোপান্ত।

ভিকটিম উত্তম আকাশ ওরফে আলিফ এর উত্তম বন্ধু ছিল ইমরান ওরফে বিশু। তবে সে সম্পর্কে চিড় ধরে দুজনের মধ্যে দেনা পাওনা নিয়ে বিরোধের সৃষ্টি হয়। বন্ধুত্বের আড়ালে বন্ধুকে হত্যার ছক আঁকে ইমরান। ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ খ্রি. মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে ইমরান তার বাড়িতে ডেকে আনে বন্ধু আলিফকে। রাতে খাবার শেষে দুই বন্ধু মিলে ফসলের মাঠে যায় ঘুরতে। ভিকটিম আলিফ শীত নিবারণে প্যান্টের দুই পকেটে হাত ঢুকিয়ে হাটছিল। এ সুযোগ মোটেও হাতছাড়া করেনি ইমরান। কোমর থেকে কাপড়ের বেল্ট খুলে হঠাৎ আলিফের গলায় জোরে পেঁচিয়ে ধরে। দম বন্ধ হয়ে মূহুর্তে‌ই মারা যায় আলিফ। পরিকল্পনা অনুযায়ী আগে থেকেই ইমরান পাঁচ লিটার কেরোসিন তেল কিনে প্লাস্টিকের ড্রামে রেখেছিল চকের মাঝে। আলিফের লাশ কাঁধে তুলে নিয়ে প্রায় ৫০০ মিটার দূরে কেরোসিন তেলের ড্রামের কাছে যায়। প্রথমে ফসলের শুকনা ডগা বিছিয়ে তার উপর আলিফের লাশ রেখে আরো বেশ কিছু ফসলের শুকনা ডগা দিয়ে ঢেকে দেয়। তারপর পাঁচ লিটার কোরোসিনের পুরোটাই ঢেলে দেয় বন্ধুর লাশের উপর। তারপর প্লাস্টিকের ড্রামটি লাশের উপর রেখে আগুন লাগিয়ে দেয়। চিতার আগুনে জ্বলতে থাকে এক বন্ধুর মরদেহ, আরেক বন্ধু ঠান্ডা মাথায় দ্রুত চলে যায় বাড়িতে। তবে ভিকটিম আলিফের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি নিয়ে ইমরান। ঢাকায় তার অফিসের জনৈক মোশারফের নিকট বিক্রয়ও করে। কিন্তু মোবাইলটি লক থাকায় মোশাররফ ফোনটি ফেরৎ দেয় ইমরানকে। এরপর মোবাইলের ব্যাটারি খুলে রেখে ফোনটি ফেলে দেয় বুড়িগঙ্গা নদীতে। আলামত হিসেবে জব্দ করা হয়েছে সে ব্যাটারি ও হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত বেল্টটি। বিজ্ঞ আদালতে খুনের দায় স্বীকার করে ২৯ ফেব্রুয়ারি ফৌঃকাঃবিঃ ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি প্রদান শেষে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়েছে আসামি ইমরানকে।

নাটক বা সিনেমায় দেখা যায় বন্ধু খুন করে বন্ধুকে। তবে খুনের পর বেঁচে থাকা বন্ধুটি চরম অনুশোচনাবোধে অনেক সময় পাগল হয়ে যায়। কিন্তু এক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম। আসামি ইমরানের কোন অনুশোচনাবোধ নেই। খুনের পর খুব সহজভাবে নিজ কর্মস্থলে কাজ করেছেন। কেউ সন্দেহ দূরে থাক, তার প্রতি কোন বিরূপ ধারণাও কেউ পোষণ করেনি। এমন বন্ধুর শত্রু হওয়াও ভয়ঙ্কর। তদন্তকারী অফিসারসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ।