ঢাকা শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১


দুধে অ্যান্টিবায়োটিক


২৫ জুলাই ২০১৯ ২১:১৩

ছবি সংগৃহিত

কোন শব্দ ব্যবহার করব ঠিক বুঝতে পারছি না। বিষাক্ত, দূষণ না ভেজাল। চরম এক সংকটময় পরিবেশের মধ্যে বসবাস করছে বাংলাদেশের লোকজন। খাদ্যে বিষ, পানিতে ভেজাল, বাতাসে দূষণ, মাটিতেও আজকাল বিষ মিশে যাচ্ছে। চারদিকে এক বিষময় বিষাক্ত, দূষিত, ভেজাল পরিবেশ। কিছুদিন আগে দেখলাম, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বায়ু দূষিত শহর হচ্ছে নারায়ণগঞ্জ। একসময়ের প্রাচ্যের ডান্ডিখ্যাত এ শহর এখন এক পচা, পূতিগন্ধময় নগরে পরিণত হয়েছে। শীতলক্ষ্যার তীরে দুদণ্ড দাঁড়ানোর উপায় নেই। কালো বিষাক্ত পানির আধারে পরিণত হয়েছে শীতলক্ষ্যা। সঙ্গে তীব্র কটুগন্ধ। শহরের বাইরে যাবেন? ড্রেন, নালা, খাল পরিপূর্ণ শিল্পের রাসায়নিক বর্জ্যে।

শিল্প শহরগুলোয় দূষণ পরিস্থিতি কমবেশি নারায়ণগঞ্জের মতোই। বাতাস ও পানি না হয় অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়নের কারণে দূষিত হচ্ছে, খাদ্যপণ্যেও স্বস্তি নেই। বাজারে কীটনাশক নামক বিষমিশ্রিত শাকসবজি। মৌসুমি ফল খাবেন, সেখানেও নানা ধরনের প্রিজারভেটিভ। চালেও হরেক রকমের কেরামতি করা হয় ঝকঝকে ও ছোট করার জন্য। শাক, সবজি, মাছ, মাংস—কোনো কিছুই আর নিরাপদ না। এমন কিছু কি আছে, যা আপনি নিশ্চিন্তে খেতে পারবেন? ভয়ংকর এক বিষাক্ত শৃঙ্খলের চক্করে পড়েছি আমরা। কোথাও কোনো বিকার নেই।

সর্বশেষ আলোচনায় এসেছে দুধ। এত দিন শুনতাম, দুধে বড়জোর পানি মেশানো থাকে। কিন্তু এখন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে প্যাকেটজাত তরল দুধে মিলছে নানা ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকও। এই দুধ পান করলে শরীরে এমনিতেই অ্যান্টিবায়োটিক ঢুকে যাবে। ধারণা করা হচ্ছে, গরুকে নির্বিচারে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানোর কারণেই দুধে অ্যান্টিবায়োটিকের অস্তিত্ব মিলছে। এ ছাড়া খাদ্য থেকেও সিসাসহ নানা ধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ পশু ও মাছের দেহে ঢুকতে পারে।বিষয়টি কয়েক বছর ধরেই আলোচনা হচ্ছে।

পরিবেশ ও প্রকৃতির ওপর এসব ভেজাল ও বিষাক্ত খাবারের প্রতিক্রিয়া খুবই ভয়াবহ। ভারতের মহারাষ্ট্রে একবার শকুনের সংখ্যা কমে গিয়েছিল। কারণ হিসেবে দেখা গেল, মৃত গরু ভক্ষণ করে শকুনের দল মারা পড়ছে। অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, গরুকে অতিরিক্ত ডাইক্লোফেনাক খাওয়ানোর কারণে শকুনই মারা যাচ্ছে। তাহলে সেই গরুর মাংস মানবদেহে গেলে এর প্রতিক্রিয়া কী ভয়াবহ হবে, তা সহজেই অনুমানযোগ্য।

বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকসম্পন্ন দুধ পান মানবদেহের কী ধরনের ক্ষতি করতে পারে? এটা বিষয়ে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ভালো বলতে পারবেন। তবে ভালো কিছু হবে না তা সহজেই অনুমানযোগ্য। এদিকে-সেদিকে কান পাতলেই শুনি নানাজনের অসুস্থতার সংবাদ। জটিল রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছেই। অল্প বয়সে এত মানুষ অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে কেন? বিষাক্ত পরিবেশ ও ভেজাল খাদ্যের সঙ্গে অকাল রুগ্‌ণতার সম্পর্ক থাকতে পারে। দেশের মানুষের আয়ের বড় একটি অংশই চিকিৎসার জন্য খরচ হয়ে যাচ্ছে।

সরকার বা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো জনসাধারণের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে পারেনি। দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা যে পুরোপুরিই ব্যর্থ বা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক প্রথম দফা পরীক্ষা করে জানালেন, দুধে অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া যাচ্ছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান বিএসটিআই গত ৫ জুন হাইকোর্টে প্রতিবেদন জমা দিয়ে বলল, দেশের পাস্তুরিত তরল দুধে কোনো সমস্যা নেই। অধ্যাপক ফারুক দ্বিতীয় দফা পরীক্ষা করে জানালেন, দুধ নিরাপদ নয়। শেষ পর্যন্ত বিএসটিআই এখন বলছে, দুধে অ্যান্টিবায়োটিক পরীক্ষার কোনো যন্ত্রই নেই তাঁদের। তাহলে দুধ নিরাপদ বলে হাইকোর্টে প্রতিবেদন দাখিল করল কেন? পণ্যে ভেজাল নিরূপণের দায়িত্বে থাকা বিএসটিআই কি নিজেরাই ভেজালের সঙ্গে জড়িত?

অধ্যাপক ফারুক বড় ধরনের প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। অধ্যাপক ফারুকের পরীক্ষায় ভুলও থাকতে পারে। বিএসটিআইয়ের সক্ষমতা না থাকলে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণাগারের (সায়েন্স ল্যাব) থাকা উচিত। সেখানে পরীক্ষা করা যেতে পারে। প্রয়োজনে অধ্যাপক ফারুক, বিএসটিআই ও সায়েন্স ল্যাবের সমন্বয়ে একটি দল গঠন করে পরীক্ষা করা যেতে পারে। এটাও যদি সম্ভব না হয়, তবে বিদেশি ল্যাব থেকে পরীক্ষা করা যেতে পারে। বিদেশে পরীক্ষা করার আর্থিক সক্ষমতা নিশ্চয়ই বাংলাদেশের আছে। সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে এর সঠিক বিহিত করা। কারণ, জনস্বাস্থ্যের জন্য অধ্যাপক ফারুকের তথ্য খুবই উদ্বেগজনক।

ড. মারুফ মল্লিক, ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব ওরিয়েন্ট অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব বন