ঢাকা শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৬ই চৈত্র ১৪৩০


রাষ্ট্রকেই দায়িত্ব নিতে হবে


১৭ জুলাই ২০১৯ ০৪:০১

ফেনীর সোনাগাজী মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি থেকে বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যাসহ সমসায়িক অপরাধমুলক কর্মকান্ড নিয়ে একটু চিন্তা করলে অনেকেই প্রশ্ন তুলবেন, এই ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার জন্য মুলত কে দায়ি? রাষ্ট্র, নাকি রাষ্ট্রযন্ত্র? রাষ্ট্রযন্ত্র যেহেতু রাষ্ট্রদ্বারা পরিচালিত, তাই রাষ্ট্র নিজেও এই দায় এড়াতে পারে না।

অপরাধীর দৃষ্টান্ত শাস্তির দাবিতে স্যোশাল মিডিয়া থেকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন যখন একের পর এক সমালোচনায়, আন্দোলনে ওই অপরাধ-অপরাধীর বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রকাশ করেছে, তখন এক প্রকার বাধ্য হয়েই রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিয়েছে। আর তখনই রাষ্ট্রযন্ত্রের অবহেলার খতিয়ানও প্রকাশ পেয়েছে।

শুধু প্রকাশই নয়, সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্রযন্ত্রের কতিপয় কর্তাব্যক্তির অবহেলার পাশাপাশি কীভাবে দীর্ঘদিন ধরে অপরাধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে-এটিও সরকার প্রধানসহ জনগণের সামনে উঠে এসেছে। আর এটা যে শুধু ফেনী জেলা, উপজেলা সোনাগাজীর সীমানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়-এটিও সরকার প্রধানসহ দেশের জনগণের সামনে স্পষ্ট হয়েছে বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যার দৃশ্যপট ভাইরাল হওয়ার মাধ্যমে।

এই দুটো ঘটনা বিচ্ছিন্ন বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মুল অপরাধীদের আড়াল করার দায় নিতে পারি না। এইসব অপরাধীকে একশ্রেণির রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ রাষ্ট্রযন্ত্রের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা শুধু ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য আশ্রয়-প্রশ্রয় কিংবা পরোক্ষ-প্রত্যক্ষভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে শুধু জনগণের জানমালের ক্ষতিই করছে না, সরকার প্রধানকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে। নুসরাত হত্যার পিবিআই’র তদন্ত রিপোর্ট, গণমাধ্যমের অনুসন্ধান প্রতিবেদন এবং সর্বপরি স্থানীয় অনলাইন অ্যাক্টিভিষ্টদের গ্রহণযোগ্য মতামত, ছবি, কয়েক মিনিটের ভিডিও যেভাবে ভাইরাল হয়েছে, তাতে ফেনী জেলার পুলিশ সুপারসহ সোনাগাজী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি), তদন্ত কর্মকর্তাসহ (তদন্ত ওসি) স্থানীয় কতিপয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ; নুসরাত হত্যার মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। যদিও ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে হত্যায় সহযোগিতা বা সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে অবহেলার জন্যে নয়, মামলা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে।

অথচ, রাষ্ট্রযন্ত্রের ওই কর্মকর্তারা তাদের ওপর অর্পিত সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য একদিকে তাদের সদর দপ্তরকে লিখিতভাবে মিথ্যা তথ্য দিয়ে পুরো পুলিশ বাহিনীকে প্রশ্নবিদ্ধ করার ষড়যন্ত্র করেছে, অন্যদিকে মুল অপরাধীদের বাঁচানোর সকল রকম চেষ্টাও করেছে।

এদিকে বরগুনার নয়ন বন্ডের বিরুদ্ধে একদিনে বা এক সপ্তাহে কিংবা এক মাসেই দশ-দশটি মামলা হয়নি। আবার নয়ন বন্ড রাতারাতি ছিচড়ে চোর থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসীও হয়ে ওঠেনি। তাকে শীর্ষ সন্ত্রাসী থেকে রিফাতখুনী বানানো হয়েছে। বরগুনার কোনও পুলশি কর্মকর্তা যখন বেসরকারী টেলিভিশন টকশোতে বলে, ইয়াবার চালানটি ছোট ছিল! তখন বুঝতে হয়, নয়ন বন্ড কার দ্বারায় পৃষ্টপোষক পেয়ে আসছে। কারা নয়ন বন্ডের মাদক ব্যবসার টাকা ভাগাভাগি করে নিয়েছে।
আবার অন্যদিকে, স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান যখন নয়ন বন্ডের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের খতিয়ান জানার পরেও আইন শৃঙ্খলাবাহিনী দ্বারা স্থানীয় জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে উল্টো স্থানীয় লোক কর্তৃক অভিযুক্ত হয়, তখন বুঝা যায়-ছিচকে চোর থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসী হয়ে ওঠার পেছনে মুলতা কারা কারা আশ্রয়-প্রশ্রয় কিংবা পৃষ্ঠপোষক করেছে।
এখানে ভাগ্য ভালো ফেনীর সোনাগাজী মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত হত্যার প্রধান আসামী তথাকথিত অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ দৌলার। তাকে বাঁচানোর জন্য স্বয়ং রাষ্ট্রযন্ত্রের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা তদবীর লবিংসহ অবশেষে কতিপয় নষ্ট সংবাদকর্মীদের দিয়েও অগ্রহণযোগ্য মিডিয়া ও স্যোশাল মিডিয়ায় প্রচার-প্রকাশ করিয়েছে ‘নুসরাত আত্মহত্যা করেছে’ বলে। কিন্তু তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে সিরাজ-উদ দৌলা নিহত হয়নি।
সাংবাদিক, লেখক, গবেষক, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষের সাথে চা-এর টেবিলে কথা হলে সবাই নয়ন বন্ডকে দুর্ভাগা বলে। সেও কারাগারে থাকা অবস্থায় রিফাতকে হত্যা করলে হয়তো সিরাজ-উদ দৌলার মত প্রাণে বেঁচে যেত। গ্রেফতারের অভিযানের নামে তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে প্রাণহীন নিরব-নিথর দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে থাকার দৃশ্যটি ভাইরাল হতো না।

আমিও অন্য সবার মতন বন্দুকযুদ্ধের এই হত্যার মহাউৎসবে স্যোশাল মিডিয়ায় মতামত তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। একেকবার আমিও খুনীদের খুন করে সমাজ-রাষ্ট্রকে অপরাধমুক্ত করতে শিউরে উঠি। কিন্তু পরোক্ষনেই যখন দেখি, মানুষ আকারে বস্ত্রহীন যে প্রাণীটি জন্মলাভ করে ধীরে ধীরে সত্যিকারের মানুষ হওয়ার প্রতিযোগিতায় এক অজানা যুদ্ধের পথে নিজেকে নিয়োজিত রাখে, যখন দেখি সেই পথে কতিপয় ভন্ড রাজনীতিবিদ বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তখন আমিও সেই খুন করার দিবাস্বপ্ন থেকে বাস্তবতায় ফিরে আসি। মানুষ থেকে অপরাধী হয়ে উঠার পিছনে রাষ্ট্রযন্ত্রের কতিপয় কর্তাব্যক্তির পৃষ্ঠপোষক দেখে আমি সত্যিই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি।

আমি সত্যিই আতঙ্কিত আমার/আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম নিয়ে। কার ভরসায় তাদের ধীরে ধীরে বড় করবো? কোন নিশ্চয়তায় এ সমাজ-রাষ্ট্রে নিরাপত্তাবোধ করবো? যেভাবে সাত বছরের সায়মা ধর্ষনের হাত থেকে রেহায় পায়নি, যে সায়মাকে ধর্ষণের পর হত্যা করে তার পৃথিবীতে আসার সকল গল্প চিরতরের জন্য থামিয়ে দেয়, তখন আমি বা আমরা বিচলিত হয়ে পড়ি। আমাদের সন্তানদের নিয়ে অজানা ভয়-আতঙ্ক কাজ করে।

আমি মনেকরি, তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে সাময়িকভাবে একটি অপরাধীকে এ পৃথিবী থেকে বিদায় করতে পারলেও অপরাধ প্রবনতা কি চিরতরের জন্য বিদায় করা সম্ভব হয়েছে বা আদৌ সম্ভব (?)-এই বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা করে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

রিফাতকে কুপিয়ে হত্যা করার সময় কেন সাধারণ মানুষ সহযোগিতা করেনি কিংবা রিফাতের স্ত্রীর সাহায্যের আবেদনেও কেন সাড়া দেয়নি-এটি দেশের অধিকাংশ মানুষের সাথে খোদ আদালত পর্যন্ত অবাক হয়েছেন। শুধু তাই নয়, মানুষ তো আগে এমন ছিলো না-এমন মন্তব্যও আদালত করেছে।

কিন্তু অতীতে যারা নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে খুনীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে, সত্যের পক্ষে স্বাক্ষী দিয়েছে-এ রাষ্ট্র কিংবা রাষ্ট্রযন্ত্র ওইসব সাহসী মানুষের জন্য কী করেছে? ব্লগার ওয়াশিকুর রহমানকে হত্যার সময় তৃতীয় লিঙ্গের লাবণ্য নিজের জীবনের কথা চিন্তা না করে জাপটে ধরেছিল খুনীকে। কী রকমভাবে জীবন-যাপন করছে ওই লাবণ্য-এই রাষ্ট্র কিংবা রাষ্ট্রযন্ত্র একবারও খোঁজ খবর নিয়েছে? লাবণ্য এখন মিডিয়াতে মুখ ঢেকেও কথা বলতে চায় না। সাংবাদিকদের অনুরোধ করে, আমাকে আর ভাইরাল করবেন না। কারণ, এই সাহসী লাবণ্য নিজের নাম-পরিচয় লুকিয়ে ঠিকানা বদল করে জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়েছে। কখন যে তার মাথার উপর খুনীদের কোপ পড়ে, এই দুশ্চিন্তায় প্রতিটি মুহুর্ত কাটছে তার।
আমি দেখেছি ব্লগার নিলাদ্রী চট্টপাধ্যায় (নিলয় নীল) রাষ্ট্রের কাছে নিরাপত্তা চেয়েও পায়নি। রাষ্ট্রযন্ত্রের কর্তাব্যক্তিরা তার নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে বরং পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। আর পুলিশের ওই পরামর্শ অনুযায়ী নিলয় পালিয়ে না গিয়ে প্রতিক্রিয়াশীলদের চাপাতির কোপে মৃত্যুর কাছে তার জীবন পরাজীত হয়েছে।

আমি মনে করি, এটা ব্লগার নিলয়, টেকনাফের পৌর কাউন্সিলর একরামুল হক, নয়ন বন্ডদের জীবন বাঁচাতে ও জীবন সাঁজাতে এ রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়েছে, পরাজয়ের পদচিহ্ন তৈরি করেছে। এটা রাষ্ট্রের পরাজয়। কারণ, রাষ্ট্রযন্ত্রের দায়িত্ববান কর্তাব্যক্তির দায়িত্বের অবহেলায় মানুষ থেকে ছিচকে চোর ও পরে শীর্ষ সন্ত্রাসী হয়ে যায়। টগবগে তরুণকে খুনী করে গড়ে তুলে এদেশের কতিপয় রাজনীতিবিদ। দেশের জনগণের জানামালের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ সাংবিধানিক এই দায়িত্ব পালন না করে বরং রাষ্ট্রযন্ত্রের কতিপয় অসাধু কর্তাব্যক্তি শুধু ব্যক্তিগত স্বার্থের লোভে অপরাধ ও অপরাধীকে আশ্রয়, প্রশ্রয় দিয়ে মুলতকে রাষ্ট্রকে অকার্যকর এবং সরকার ও সরকার প্রধানকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে যা ফেনী থেকে বরগুনার হত্যাগুলো আমাদের নতুন করে ভাবনার দৃশ্যপট তৈরি করেছে, সময় উপযোগি সিদ্ধান্ত নেওয়ার বার্তা দিচ্ছে।

এখানে, রাষ্ট্রকেই দায়িত্ব নিতে হবে। যোগ্য লোক দ্বারা রাষ্ট্রযন্ত্র সাঁজানোর পাশাপাশি সরকারকেই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আর অসাধু রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রযন্ত্রের অসাধু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেওয়া, আইনের আওতায় এনে অপরাধ অনুযায়ী শাস্তির বিধান নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র বা সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ, রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতি জনগণের অস্থার সংকট তৈরি হলে সেটা সরকারকেই বহন করতে হয়, সরকারের গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পায়। সরকারের ভালো কাজগুলোও মøান হয়ে পড়ে।

তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধ নয়, আইনের শাসন নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রযন্ত্রের কর্তাব্যক্তিদের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে আন্তরিক করে গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে হবে। অপরাধীদের বিচারবহির্ভূত হত্যার চেয়ে অপরাধ প্রবনতারোধ করতে গবেষণা করে তার উপায় খুঁজে বের করা উচিত। জনগণের দায়িত্ববোধ, সচেতনতা বৃদ্ধি, মানুষের মাঝে মানুষের সম্প্রীতির বন্ধন সৃষ্টি করতে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। অপরাধী নয়, মানুষ হয়ে বাঁচার অধিকার নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রকেই দায়িত্ব নিতে হবে।

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিষ্ট ফোরাম (বোয়াফ)
ই-মেইল: kabir_tanmoy@yahoo.com