শাফিয়ার শরীরে যৌতুকের আগুন

যৌতুকের অভিশাপে আর কত গৃহবধূকে এভাবে ঝরাতে হবে প্রাণ? কে নেবে এর দায়?
গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় যৌতুকের টাকা দিতে না পারায় অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন শাফিয়া খাতুন (২৪) নামে এক গৃহবধূ।
যৌতুকের টাকা দিতে না পারায় স্বামী তার শরীরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করতে চেয়েছিল বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
শাফিয়া খাতুন গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার আলিঠাপাড়া গ্রামের ওবায়দুল রহমানের মেয়ে। একই উপজেলার উত্তর হিরণ গ্রামের আবু তালেব খানের ছেলে আলামিন খানের সাথে ২০১৪ সালের ১৪ অক্টোবর বিয়ে হয় তার। বিয়ের দুই বছর পরে তাদের কোল জুড়ে আসে একটা কন্যা সন্তান মারিয়াম (৩)।
ভিকটিমের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ২৫ জুন আনুমানিক বেলা ১১টার সময় ঘরে শুয়ে থাকা অবস্থায় শাফিয়ার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেয় তার স্বামী। ওই দিন সন্ধ্যায় সাত জনকে আসামি করে থানায় অভিযোগ দায়ের করেন ভিকটিমের চাচা বাচ্চু মিয়া।
বাচ্চু মিয়া জানান, সকাল ১১টায় ঘটনা ঘটে। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় ৪টার পরে। সেখানে ডাক্তার তার অবস্থা বেগতিক দেখে তাকে ঢাকা মেডিকেলে স্থানান্তর করেন।
শাফিয়ার শরীরের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ জায়গা ঝলসে গেছে। গত ৪ সেপ্টেম্বর রাত ১২ টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে তাকে হঠাৎ করে রিলিজ দিয়ে দেওয়া হয়।
এখন পশ্চিম ভাষানটেক মজুমদারের অফিস টেক বস্তিতে বিছানায় শরীরের অস্বাভাবিক যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন এই গৃহবধূ। পারিবারিক অবস্থা খুব বেশি ভালো না হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য কোথাও নিয়ে যেতে পারছেন না পরিবারের সদস্যরা।
শরীরের এই পোড়া যন্ত্রণা নিয়ে মৃত্যুর প্রহর গুণছেন শাফিয়া।
শাফিয়া এই প্রতিনিধিকে জানান, যৌতুকের টাকা চেয়ে একের পর এক বিভিন্ন তালবাহানা করে তার স্বামী নির্যাতন করতে থাকে। তার নির্যাতনের হার দিন দিন বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে এসে তার খাবার বন্ধ করে দেয় শশুরবাড়ির লোকজন। তারা বলেন, টাকা না আনলে এই বাড়িতে তোর খাবার বন্ধ। এমনভাবে তিন দিন না খেয়ে থাকি।
ঘটনার দিন আমি আমার ঘরে বাচ্চা কোলে নিয়ে দুধ খাওয়াতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। আমার ঘুম চলে আসলে আমার স্বামী আমার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়।
মামলার রেকর্ডে উল্লেখ রয়েছে, শাফিয়ার শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয় তার স্বামী। চিল্লাচিল্লি করলেও কেউ তার পাশে এসে আগুন নিভিয়ে দেয়নি। তিনি দরজাটা খুলে বাইরে আসলে ৩-৪ ঘন্টা তার শরীরে আগুন লাগা অবস্থায় ফেলে রাখে এবং তিনি নিজে তার শরীরে আগুন দিয়েছে স্বীকারোক্তি নেয়ার চেষ্টা করে। একপর্যায়ে তিনি অজ্ঞান হয়ে যায় তারপরে কি হয়েছে সেটা আর তিনি বলতে পারেন না।
ভিকটিমের মায়ের কাছে বিয়ের সময় জামাইয়ের পক্ষ থেকে কোনো দাবিদাওয়া ছিল কিনা জানতে চাওয়া হলে তিনি প্রতিনিধিকে জানান, বিয়ের সময় জামাইয়ের পক্ষ থেকে এক লাখ টাকা দাবি করলেও আমি মেয়ের গলার চেন, নাকের নোলক দেই। মুরব্বীদের সমন্বয়ে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে সমস্যা সমাধান করি যে পরে আর কোনো দাবি দাওয়া নেই। কিন্তু হঠাৎ করে আমার মেয়ের ওপরে টাকার জন্য চাপ দিতে থাকে এবং অমানুষিক নির্যাতন করে। আমি এর বিচার চাই।
ভিকটিমের বাবার কাছে এ বিষয়ে থানায় কোনো মামলা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি প্রতিনিধিকে জানান, আমরা জামাই, জামাইয়ের বাবা, মা ও বোনসহ সাত জনের নাম উল্লেখ করে থানায় একটি মামলা করেছি। পুলিশ একজনকে গ্রেফতার করলেও তাকে আমাদের জিম্মায় ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু পুলিশ আর কাউকে গ্রেপ্তার করেনি এবং কাজের কোনো অগ্রগতি নেই। ঢাকা মেডিকেলে আমার মেয়ে নিয়ে আড়াই মাস রয়েছি। গত তিন চারদিন আগে রাত ১১টার দিকে হঠাৎ করেই ঢাকা মেডিকেল আমার মেয়ের রিলিজ দিয়ে দেয়। এখন আমি এই পোড়া মেয়ে নিয়ে কি করব? মামলার বিষয় নিয়ে কোটালীপাড়া থানা পুলিশের সাথে কথা হলে তারা জানায় মেয়েকে নিয়ে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় যাওয়ার জন্য তাকে আবার জবানবন্দি নিবে।
ভিকটিমের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় হলেও তারা ২৬ বছর ধরে মিরপুর পশ্চিম ভাষানটেক মজুমদার মোড় ৬/৩, ৪ নম্বর অফিস্টেক বস্তিতে থাকে।
এই বস্তির মালিক শামসুল হক। এখানে নতুনসময় প্রতিনিধিরা গেলে আশপাশের মানুষ ভিড় জমায়। এ সময় একজন মহিলা জানাই এই মেয়ের চিকিৎসার জন্য আড়াই লক্ষ টাকা তার বাবাকে ধার দিয়েছি। কিন্তু এখন মেয়ের অবস্থা বাঁচবে কি বাঁচবে না এমন। এদের যে অবস্থা তাতে আমার টাকা-পয়সার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আমার আবেদন সরকার যেন তার জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।
হিউম্যান রাইটস রিভিউ সোসাইটির সহকারি পরিচালক রহিমা বেগম এ প্রতিনিধিকে জানান, ৩ সেপ্টেম্বর বিকালে জাতীয় জাদুঘরে একটা অনুষ্ঠানে আমাকে জানানো হয় এই ঘটনা। ৪ সেপ্টেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজে ডাক্তারের সাথে কথা হলে ওই দিন রাতেই ১২টার সময় এই মেয়েকে আকস্মিকভাবে রিলিজ দিয়ে দেয়। এমন অসহায় এবং অসুস্থ রোগীকে কিভাবে হাসপাতাল থেকে বের করে দিতে পারল সেটা আমরা জানি না। কিন্তু এটা সম্পূর্ণ মানবাধিকার লংঘন করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এখন মেয়েটি বাবার বাড়ি বিছানায় অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। গত দুই থেকে আড়াই মাস ঢাকা মেডিকেলে থেকে চিকিৎসা নেওয়ার পরও কোন উন্নতি আসেনি তার। কিন্তু এরই মাঝে তিন থেকে সাড়ে তিন লক্ষ টাকা ব্যয় হয়ে গেছে তার পেছনে। তাই আমি বলবো তার পাশে রাষ্ট্রকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য।
তিনি আরো বলেন, এই মামলায় ভিকটিমের স্বামী, শশুর, শাশুড়ি ও ননদসহ সাত জনকে আসামি করে মামলা করা হলেও এখনো পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ।
গোপালগঞ্জ কোটালীপাড়া উত্তর হিরন গ্রামের ৪ নাম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার এ প্রতিনিধিকে জানান, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কথা কাটাকাটি হওয়ায় খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয় গৃহবধূ। সেখান থেকেই এই ঘটনার সূত্রপাত এবং সে নিজে নিজেই নিজের গায়ে আগুন দিয়েছে। এখন এই ঘটনার দায় স্বামীর উপর চাপাচ্ছে। এই ভিকটিমের স্বামীর বাড়ি বিক্রি করে স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য ৫০ হাজার টাকা দিয়েছে। ৩০ হাজার টাকা কোটালীপাড়া পৌরসভার মেয়রের কাছে আর বিশ হাজার টাকা মেয়ের বাবার কাছে দেওয়া হয়েছে।
কোটালীপাড়া পৌরসভার মেয়র কামাল হোসেন ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে এ প্রতিনিধিকে জানান, ঘটনাটা হচ্ছে অমানবিক। এভাবে একটা গৃহবধূকে অত্যাচার করা উচিত হয়নি। এই ভিকটিমের চিকিৎসার জন্য স্বামীর পরিবারের পক্ষ থেকে ৩০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে বলে আমাকে জানিয়েছে।
তিনি আরো জানান, আমি শুনছি যে ৭ জনকে আসামি করে মামলা করেছে তারা। কিন্তু পুলিশ এখনো কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি।
ভিকটিমের কেসের তদন্তের দায়িত্ব রয়েছে কোটালীপাড়া থানার ইনস্পেক্টর মোস্তাফিজুর রহমান। এ বিষয়ে তিনি এ প্রতিনিধিকে জানান, এই গৃহবধূ গার্মেন্টসে কাজ করতো। তাদের পারিবারিক কোন্দল এবং তার শাশুড়ির বাজে কথার কারণে এই মেয়ে নিজের ঘরে গিয়ে নিজে নিজে নিজের গায়ে আগুন দিয়েছে। পরে তার শ্বশুর বাড়ির লোকজন তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসে।
এ বিষয়ে এই দিন ভিকটিমের চাচা বাচ্চু মিয়া থানায় একটা অভিযোগ দাখিল করেছে। আমরাও আসামি ধরার জন্য চেষ্টা করছি। কিন্তু তারা ভিটে বাড়ি বিক্রি করে কিছু টাকা ভিকটিমের চিকিৎসার জন্য দিয়েছে। আর কিছু টাকা নিয়ে তারা এলাকা ছেড়ে চলে গেছে।
এই মামলার জন্য এই ভিকটিমের কাছ থেকে জবানবন্দি নিতে হবে এবং তারা যদি চায় যে মামলা চালাবে। তাহলে আমরা চার্জশিট দাখিল করব।
একেএ