ঢাকা মঙ্গলবার, ১লা এপ্রিল ২০২৫, ১৯শে চৈত্র ১৪৩১


আবেদনের আগেই অর্থছাড়


৩০ মার্চ ২০২৫ ১০:২৭

সংগৃহীত

ব্যাংকে আবেদন করার আগেই ঋণের টাকা গ্রাহকের হিসাবে ছাড় করার ঘটনা ঘটেছে। গ্রাহক ঋণের হিসাব খোলেননি, অথচ ব্যাংকের হিসাব থেকে গ্রাহককে নগদ টাকা দেওয়া হয়েছে। পরিচালনা পর্ষদে ঋণের প্রস্তাব ওঠার আগেই টাকা দেওয়া হয়েছে। ব্যাংক চেক ছাড়াই শুধু একটি স্লিপ লিখে গ্রাহকের প্রতিনিধির কাছে নগদ টাকা দেওয়া হয়েছে। বস্তায় ভরে ব্যবসায়ীরা এসব টাকা নগদ আকারে নিয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত ১৫ বছর তাদের প্রশ্রয়ে ব্যাংক খাতে নজিরবিহীন ঋণ জালিয়াতির এসব ঘটনা উদ্ঘাটিত হয়েছে। এস আলম, বেক্সিমকো ও নাবিল গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠান এসবের সঙ্গে জড়িত। গ্রুপগুলো বাসার কাজের লোক, গাড়ির ড্রাইভার, কোম্পানির কর্মীদের পরিচালক বানিয়ে কোম্পানির নিবন্ধন নিয়েছে। তারপর তাদের নামে নেওয়া হয় ব্যাংক ঋণ। এছাড়া অস্তিত্ব নেই, এমন কোম্পানির নামেও হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে। জালিয়াতির মাধ্যমে নিজ নামে ও বেনামে নেওয়া ঋণের টাকা পাচার করা হয়েছে।

 

বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের (বিএফআইইউ) এখন পর্যন্ত পরিচালিত তদন্তের ভিত্তিতে তৈরি প্রতিবেদনে এসব চাঞ্চল্যকর ও ভয়ানক তথ্য ওঠে এসছে। তদন্ত এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে জালিয়াতির নতুন নতুন ধরন উদ্ঘাটিত হচ্ছে। এসব অনিয়ম কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেমন এড়িয়ে গেছে, তেমনি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারাও সংশ্লিষ্ট আইন প্রতিপালন করেননি। গ্রাহক নিজে নিয়মের বাইরে থেকে ঋণ নিয়েছেন। কোনো পক্ষই আইনের মধ্যে আসেনি। উল্লিখিত তিনটি গ্রুপের মোট ঋণের হিসাব নিয়েও মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হয়েছে। আওয়ামী লীগ আমলে তাদের ঋণের যে তথ্য দেওয়া হয়েছে বর্তমান সরকারের হিসাবের সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। তাদের ঋণের পরিমাণ ক্রমশ বেড়েই চলেছে। যা আগে পোগন রাখা হয়েছিল।

 

সূত্র জানায়, ঋণ নেওয়ার আগে গ্রাহককে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের শাখায় আবেদন করতে হবে। শাখা থেকে আবেদন পর্যালোচনা ও প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাই করে আঞ্চলিক অফিস বা প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়ে থাকে। তারা যেটি আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পাঠাবে ব্যাংকের ক্রেডিট কমিটিতে। কমিটি অনুমোদন করলে তা পাঠানো হবে পরিচালনা পর্ষদে। পর্ষদ অনুমোদন করলেই শর্ত মোতাবেক ঋণের অর্থ ছাড় করা হবে। তার আগে গ্রাহককে যে কোম্পানির নামে ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে তার নামে হিসাব খুলতে হবে। সে হিসাবে ব্যাংক পর্ষদের অনুমোদনের শর্ত অনুযায়ী ঋণ ছাড় করবে। জনতা ব্যাংক থেকে বেক্সিমকো গ্রুপের একটি ঋণের ক্ষেত্রে আলোচ্য কোনো নিয়ম-কানুনই মানা হয়নি। এমন কি গ্রাহক ঋণের জন্য আবেদনই করেননি। সালমান এফ রহমানের মুখের কথায় জনতা ব্যাংকের হিসাব থেকে ঋণের টাকা গ্রাহককে নগদ আকারে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরে জগাখিচুড়ির মাধ্যমে ঋণের কাগজপত্র তৈরি করা হয়েছে।

 

এস আলম গ্রুপ ইসলামী ব্যাংক দখলের পর ব্যাংকটির বিভিন্ন শাখা থেকে পানির মতো ঋণ নিয়েছে। এক্ষত্রে কোনো নিয়মকানুন মানা হয়নি। ঋণের আবেদন পর্যন্ত অনুমোদন করেনি। এমন কি ক্রেডিট কমিটিও সেটি পর্যালোচনা করেনি। কিন্তু গ্রাহকের হিসাবে ঋণের টাকা ছাড় হয়ে গেছে। পরে ঋণটি খেলাপি হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদন্ত করে কোম্পানির কোনো অস্তিত্ব পায়নি।

 

ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে হলে চেক বা ভাউচার লাগবে। কিন্তু এসব ছাড়াই এস আলমের নির্দেশে শুধু একটি স্লিপ লিখে ব্যাংক থেকে গ্রাহককে নগদ আকারে টাকা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ এভাবে টাকা দেওয়ার কোনো বিধান নেই। ব্যাংক মোটা অঙ্কের টাকা নগদ আকারে দিতে পারে না। চেক বা ড্রাফট আকারে দেবে বা গ্রাহকরে কাঙ্ক্ষিত হিসাবে স্থানান্তর করে দেবে।

 

মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী বেনামি হিসাব খোলা, বেনামি কোম্পানি খোলার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু নাবিল গ্রুপ বেনামি কোম্পানি ও বেনামি ব্যাংক হিসাব খুলেছে। ওই হিসাবে ব্যাংকের সঙ্গে টাকার লেনদেন করেছে। এক্ষেত্রে দুই পক্ষই মানি লন্ডারিং অপরাধ করেছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। ইসলামী ব্যাংকের কয়েকটি শাখা থেকে ব্যাংকটি এসব ঋণ নিয়েছে।

 

সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জানা গিয়েছিল বেক্সিমকো গ্রুপের মোট ঋণের স্থিতি ১২ হাজার কোটি টাকা। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর পরিচালিত তাৎক্ষণিক তদন্তে বের হয়েছিল বেক্সিমকো গ্রুপের মোট ঋণের স্থিতি ৩৬ হাজার কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত তদন্তে এ গ্রুপের মোট ঋণের স্থিতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। তাদের আরও বেনামি ঋণের তথ্য উদ্ঘাটন হচ্ছে। ফলে মোট ঋণের স্থিতি আরও বাড়ছে। এটি ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গ্রুপের নামে কোনো খেলাপি ঋণ ছিল না। অনেক ঋণ খেলাপি হওয়ার যোগ্য থাকলেও রাজনৈতিক প্রভাবে খেলাপি করা হয়নি। তদন্ত যত এগোচ্ছে খেলাপি ঋণ তত বাড়ছে। এখন তা বেড়ে ৫৩ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ঋণ নিয়ে যেসব অর্থ পাচার করা হয়েছে সেগুলোও এখন খেলাপি হচ্ছে।

 

এখন পর্যন্ত জনতা ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয় থেকেই গ্রুপটি ঋণ নিয়েছে ২৭ হাজার কোটি টাকা। তদন্তে আরও বেনামি ঋণের তথ্য বের হচ্ছে। এতে মোট ঋণের পরিমাণও বাড়ছে। বিশেষ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রনহমানের আমলেই বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বাড়তে থাকে। কারণ আতিউরের আমলে ব্যাংক খাতে সুশাসনের যথেষ্ট অভাব ছিল। পাশাপাশি ঋণ শৃঙ্খলাও ভেঙে পড়েছিল। যে কারণে ঋণ নিতে নিয়মকানুনের কোনো বালাই ছিল না। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বেক্সিমকো গ্রুপের কর্ণধার সালমান এফ রহমানকে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়। ফলে তিনি রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে বেপরোয়া গতিতে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। ২০১৬ সালে ফজলে কবির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্বে এলেও তিনি অনিয়মের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেননি। উলটো জালিয়াতির কার্যক্রমকে আরও সহযোগিতা করেছেন। ফলে সালমান ও এস আলমরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। ওই সময় থেকে তাদের ঋণ আরও বাড়তে থাকে। গভর্নর ফজলে কবিরের সময়ে জালিয়াত চক্রটি আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ফলে ২০২২ সালের পর থেকে ঋণ অনেক বেড়েছে।

 

সূত্র জানায়, ফজলে কবিরের সময়ে ঢাকার বাইরে থেকে বদলি হয়ে আসা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বিধিসম্মত হয়নি বলে একটি কোম্পানির ঋণের ফাইল আটকে দেন। এটি ছিল বেক্সিমকো গ্রুপের বেনামি প্রতিষ্ঠান। তিনি জানতেন না এটি বেক্সিমকো গ্রুপের প্রতিষ্ঠান। পরে সালমান এফ রহমান গভর্নরের কাছে নালিশ করেন। গভর্নরের হস্তক্ষেপে বেনামি কোম্পানির ঋণটি ছাড়ের অনুমোদন দেওয়া হয় বেআইনিভাবে। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেনামি ঋণ ছাড়ের অনুমোদন দিতে পারে না। বরং ঋণ আটকে দিতে পারে।

 

ওই সময় জানা যায়, একজন ডেপুটি গভর্নর বেক্সিমকো গ্রুপের বেনামি কোম্পানির একটি তালিকা রাখতেন। ওই তালিকার কোনো কোম্পানির ঋণ অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এলে তা দ্রুত ছাড় করা হতো। কিন্তু বেনামি ঋণের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো ব্যবস্থা নিত না। ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও কোনো ব্যবস্থা নিত না। এতে বেক্সিমকো গ্রুপ বাধাহীনভাবে বেনামি ঋণ নিয়েছে।

 

আওয়ামী লীগ সরকারের সময় এস আলম গ্রুপের ঋণের স্থিতি ৩০ হাজার কোটি টাকা। সরকারের পতনের পর তদন্ত শুরু হলে প্রথমে জানা যায় ঋণের স্থিতি ৫০ হাজার কোটি টাকা। পরে তদন্ত আরও এগোলে জানা যায় ঋণের স্থিতি ৭৫ হাজার কোটি টাকা। এভাবে তদন্ত এগোতে থাকায় এখন পর্যন্ত জানা যাচ্ছে এস আলম গ্রুপের ঋণের স্থিতি ২ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। এসব অর্থের বড় অংশই তিনি বিদেশে পাচার করেছেন। তবে পাচার করা অর্থ তার নিয়ন্ত্রণে নেই। ওই সব অর্থ চলে গেছে আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠদের নিয়ন্ত্রণে।

 

এস আলমের নির্দেশে নাবিল গ্রুপকে কোনো নথিপত্র ছাড়াই শুধু মৌখিক কথার ভিত্তিতে ইসলামী ব্যাংক থেকে টাকা দেওয়া হয়েছে। যা পুরোপুরি বেআইনি। পাশাপাশি এস আলম গ্রুপ নিজেও বিভিন্ন ব্যাংক থেকে কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই ঋণে টাকা নিয়েছে। ইসলামী ব্যাংক থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নিয়ে পণ্য আমদানির এলসি খুলেছে। কিন্তু সেই অর্থে তিনি পণ্য দেশে আনেননি। অর্থাৎ ওই টাকা পাচার করা হয়েছে। ফলে ইসলামী ব্যাংক ফোর্স লোন সৃষ্টি করে গ্রাহকের দায় শোধ করেছে। এখন পুরো টাকাই ইসলামী ব্যাংকের গচ্চা গেছে। এখন ব্যাংক ঋণকে খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করেছে।

 

নাবিল গ্রুপের ঋণের স্থিতি আগে কমই ছিল। ২০২২ সালের পর তা বাড়তে থাকে। মূলত এস আলম নিয়ন্ত্রিত তিনটি ব্যাংক থেকেই গ্রুপটি বেশি ঋণ নিয়েছে। ব্যাংকগুলো হচ্ছে, ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক। তিনটি ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে। পাশাপাশি বিধিবিধান ভঙ্গ করে বেনামে ঋণ নিয়েছে। আগে গ্রুপের নামে ঋণের স্থিতি ছিল হাজার কোটি টাকার নিচে। এখন তা বেড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি দাঁড়িয়েছে। অথচ গ্রুপটির এতবড় সম্পদ নেই। তবে গ্রুপটির দাবি, এস আলম গ্রুপ তাদের নামে ঋণ তুলে অর্থ আত্মসাৎ করেছে।