ঢাকা বুধবার, ১২ই মার্চ ২০২৫, ২৯শে ফাল্গুন ১৪৩১


ধর্ষকের বিচার দাবিতে ক্ষোভে ফুঁসছে দেশ


১০ মার্চ ২০২৫ ১১:২৮

ফাইল ফটো

দেশজুড়ে অব্যাহত ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনায় ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে পুরো দেশের মানুষ। অপরাধীদের দ্রুত গ্রেপ্তার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে সারাদেশে চলছে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদী সমাবেশ, মিছিল। 

 

গত শনিবার (৮ মার্চ) রাত থেকে বিক্ষোভ সমাবেশ শুরু করেন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গতকাল রোববার (৯ মার্চ) সকাল থেকে দিনব্যাপী এই বিক্ষোভ সমাবেশ ছড়িয়ে পড়ে দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে। ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনায় বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের মানুষ।

 

 

এদিকে নারীর প্রতি অব্যাহত সহিংসতা, নির্যাতন ও ধর্ষণ বন্ধ এবং ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গতকাল বিক্ষোভ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ঢাবির নারী শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে ধর্ষণবিরোধী মঞ্চ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে শনিবার দিবাগত রাত সাড়ে ৩টায়। বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার এবং ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানিয়েছেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা।

 

ধর্ষণবিরোধী মঞ্চের ব্যানারে গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে বিভিন্ন হল থেকে শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়ে নারী-শিশু নিপীড়ন ও ধর্ষণের প্রতিবাদ এবং ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়ে বিভিন্ন স্লোগান দেন।

 

 

রাত ৮টার দিকে একটি মশাল মিছিল নিয়ে রাজু ভাস্কর্য থেকে ভিসি চত্বর দিয়ে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করেন। ধর্ষণবিরোধী মঞ্চের পক্ষ থেকে পাঁচ দফা দাবি ঘোষণা করা হয়েছে।

এর আগে দিনের বেলায় ঢাবির অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক আয়োজিত ‘নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ সমাবেশে’ শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেন।

 

সমাবেশে সভাপ্রধানের বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন বলেন, ‘ধর্ষণের শাস্তি পাওয়া অপরাধীও জেল থেকে ছাড়া পাচ্ছে।

 

 

 

নির্যাতন যাদের থামানোর কথা, তারা চোখ বন্ধ করে রাখছে। নারী নির্যাতনের ভেতর দিয়ে মানুষকে দমিয়ে রাখা হয়। শুধু ধর্মই নয়, নির্যাতক যখন যেটা সুবিধা মনে করে, সেটাই ব্যবহার করে।’

অন্তর্বর্তী সরকারের দুর্বলতা প্রতিনিয়ত প্রকট হচ্ছে উল্লেখ করে ঢাবির অধ্যাপক ফাহমিদুল হক বলেন, ‘এর সুযোগ নিয়ে ছিনতাইকারী, ধর্ষক, ধর্মীয় লেবাসের লোকজন নারীর ওপর পুরনো ফ্যাসিজম চালাচ্ছে। গত ফ্যাসিজমের সময় ধর্মীয় জনগোষ্ঠী নানাভাবে নিপীড়নের শিকার ছিল।

 

তাদের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের সমবেদনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তারা সেই অনুভূতি ধরে রাখতে পারছে না। তারা নিজেরাই ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠছে, নিপীড়ক হয়ে উঠছে। দুর্বল সরকারের সময় যে যার শক্তি প্রয়োগ করছে।’

 

 

লেখক ও অধ্যাপক স্বপন আদনান বলেন, ‘দেশে পরিবারের ভেতর মেয়েদের আশ্রয় ভেঙে যাচ্ছে। (মাগুরায়) আট বছরের শিশুটি ধর্ষণের শিকার হয়েছে পরিবারের ভেতরেই। নারী নির্যাতনের বিষয়টিকে স্বাভাবিক করা হচ্ছে, সাফাই গাওয়া হচ্ছে। উত্ত্যক্তকারী বীরের সংবর্ধনা পাচ্ছে। প্রশাসনকে এ ব্যাপারে কঠোর হতে হবে।’

 

সমাবেশে শিক্ষক নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুত্ফা। তিনি বলেন, “৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক কর্মচারী দ্বারা ‘মোরাল পুলিশিং’ ও যৌন নিপীড়নের শিকার হন। সে ঘটনায় উগ্র সংগঠন থানায় মব সৃষ্টি করে। সন্ত্রাসী অবস্থা তৈরি করলে থানা তাদের কবজায় চলে যায়। তারা থানার ভেতর আটক ব্যক্তির লাইভ ভিডিও প্রচার করে। থানা থেকে বাদীর ব্যক্তিগত তথ্য ছড়িয়ে পড়ে। বাদীকে নানাভাবে হুমকি দেওয়া হয়। যেভাবে অপরাধীকে বিজয়ীর বেশে ছেড়ে দেওয়া হয়, তা সরকারের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার আরেকটি উদাহরণ। এ ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ।’

 

 

সমাবেশে অপরাধীদের বিচার ও শাস্তি এবং যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে সরকারকে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণের দাবিসহ বেশ কিছু দাবি তুলে ধরে শিক্ষক নেটওয়ার্ক। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের আয়োজনে একই ধরনের প্রতিবাদী সমাবেশ করা হয় রাজধানীর বেসরকারী নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে।

 

এর আগে গত শনিবার রাত থেকেই ধর্ষকের বিচার ও নারীর ওপর নির্যাতন বন্ধের দাবিতে উত্তাল হতে শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। রাতে সব হল থেকে বের হয়ে এসে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেন বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা। পরে এই বিক্ষোভে যোগ দিতে থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও।

 

 

ধর্ষকের বিচার দাবিতে গতকাল ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক বিভাগের শিক্ষার্থীরা। বাংলা বিভাগ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ভাষাবিজ্ঞান, ইংরেজি, লোকপ্রশাসন, রসায়ন, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান, পদার্থ, ভূতত্ত্বসহ বেশ কয়েকটি বিভাগের শিক্ষার্থীরা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে গতকাল বিক্ষোভ করেন।

 

বিক্ষোভে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা ‘আমার সোনার বাংলায়, ধর্ষকদের ঠাঁই নাই’, ‘তুমি কে আমি কে, ... ...’, ‘আমার বোন তোমার বোন, ... ...’, ‘আমার বোনের কান্না, আর না আর না’ ইত্যাদি স্লোগান দেন।

 

‘ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ’ প্ল্যাটফর্মের ব্যানারে গতকাল বিকেল পৌনে ৩টার দিকে টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের সামনে থেকে লাঠি মিছিল বের করা হয়। লাঠি হাতে মিছিল রাজু ভাস্কর্য থেকে শুরু করে ভিসি চত্বর, নীলক্ষেত, কাঁটাবন, শাহবাগ মোড় ঘুরে আবার রাজু ভাস্কর্যে এসে শেষ হয়। কর্মসূচিতে ঢাবির শিক্ষক সামিনা লুত্ফাসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সদস্য ও শিক্ষার্থীরা অংশ নেন। এই কর্মসূচি থেকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার অপসারণ এবং দ্রুত ট্রাইব্যুনালে সব ধর্ষণকারীর বিচারসহ ৯ দফা দাবি তুলে ধরা হয়।