টার্গেট ব্যাংক গ্রাহক, ব্যবহার র্যাবের পোশাক

রাজধানীর কাউলা হতে র্যাব পরিচয়ে অপহরণসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের মূল হোতাসহ ৭ সক্রিয় সদস্যকে অস্ত্র, গুলি, র্যাবের জ্যাকেট, হ্যান্ডকাফ, র্যাব স্টিকারযুক্ত মাইক্রোবাসসহ গ্রেফতার করেছে র্যাব-১।
মঙ্গলবার (৫ নভেম্বর। সকাল ১১ টায় কারওয়ান বাজার র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ান (র্যাব) এর মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে র্যাব মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান এসব তথ্য জানান।
তিনি জানান, গ্রেফতার কৃত অপরাধী চক্রের সক্রিয় সদস্যরা নিজেদেরকে র্যাব সদস্যের ন্যায় বেশভূসা ধারণ করে ও র্যাবের পরিচয় দিয়ে দেশের মধ্যে অপহরণ, ছিনতাই, ডাকাতি, হত্যাসহ নানাবিধ অপরাধ সংগঠিত করছে। তারা নিজেদেরকে র্যাব সদস্য হিসেবে উপস্থাপন করতে র্যাবের জ্যাকেটের ন্যায় জ্যাকেট ব্যবহার, ওয়াকিটকি ব্যবহার, হ্যান্ডক্যাফ, আইডি কার্ড ও অস্ত্র বহন করে থাকে।
নিজেদের র্যাবের ন্যায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য হিসেবে আরো বিশ্বাসযোগ্য করতে র্যাবের স্টিকার তৈরি করে বিভিন্ন মানানসই গাড়ি ব্যবহার করে। এ ধরনের অপরাধী দলের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে বেশ কয়েকজন ভিকটিম র্যাবের নিকট অভিযোগ করে। যার ফলশ্রুতিতে র্যাব বিষয়টির উপর গুরুত্বরোপ করে ছায়া তদন্ত ও গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করে।
এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল রোববার (৪ নভেম্বর) রাত সাড়ে ১০ টায় গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে একটি অপরাধ সংগঠিত করার প্রস্তুতিকালে এই অপরাধী চক্রের ৭ সদস্যকে গ্রেফতার করে র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন-মুন্সিগঞ্জ টঙ্গীবাড়ীর মৃত আবেদ আলী ব্যাপারী ছেলে কাসেম ওরফে জীবন (৫৮), ভোলা চর ফ্যাশনের আবুল বাশারের ছেলে ইব্রাহিম খলিল (৪০), মাদারীপুর শিবচরের শহীদ ব্যাপারীর ছেলে জাকির হোসেন সুমন (২৭), বরিশাল মেহেন্দীগঞ্জের আব্দুর রাকিবের ছেলে বিল্লাল হোসেন আসলাম (৩২), নারায়ণগঞ্জ ফতুল্লার মৃত সাইজ উদ্দিনের ছেলে আব্দুল মন্নান (৫০), বরগুনার সিদ্দিক ভূইয়ার ছেলে সোহাগ (২৭), নারায়ণগঞ্জ ফতুল্লার আব্দুল গফুরের ছেলে আরিফ (২৮)।
এ সময় তাদের কাছ থেকে একটি বিদেশী পিস্তল, ২ রাউন্ড এ্যামোনেশন, ২টি হ্যান্ডকাফ, ২টি র্যাব জ্যাকেট, একটি র্যাব বোর্ড, ২টি সিগন্যাল লাইট, ৬টি বড় লাঠি, দড়ি,একটি ওয়াকিটকি সেট, ৪টি চোখ বাঁধার কালো কাপড়, ১৪টি মোবাইল, ৪টি মানিব্যাগ, একটি ওরলেস, একটি ম্যাগাজিন, নগদ ২৮ হাজার টাকা এবং একটি কালো গ্লাসের র্যাব ষ্টীকার যুক্ত হায়েস মাইক্রোবাস জব্দ করা হয়।
মুফতি মাহমুদ খান জানান, আসামিদের কাছ থেকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, উক্ত অপরাধ চক্রের মূল হোতা কাশেম ওরফে জীবন। এই সংঘবদ্ধ চক্রের স্থায়ী সদস্য ১০ থেকে ১১ জন বলে তারা জানান। এই অপরাধী চক্রের সদস্যরা দীর্ঘদিন নানাবিধ অপরাধের সাথে যুক্ত। ফলে পরিচয়ের সূত্রে বিভিন্ন ধরণের অপরাধ সংগঠনের ক্ষেত্রে আরো ১৫ থেকে ২০ জন অপরাধী সম্পৃক্ত রয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে এদের মধ্য হতে গ্রেফতারকৃত কাশেম ওরফে জীবন ভাড়া করে থাকে।
এসময় তারা আরও জানান, অপরাধ চক্রটি বিগত ৩ থেকে ৪ মাস যাবত সংঘটিত হয়েছে। এই অপরাধী চক্রটি নিজেদেরকে র্যাব হিসেবে উপস্থাপন করতে র্যাব জ্যাকেট, হ্যান্ডকাফ, ওয়াকিটকি ইত্যাদি ব্যবহার করে থাকত। তারা বিভিন্ন হাইওয়েতে ডাকাতি, ছিনতাই ও চাঁদাবাজিসহ নানাবিধ অপরাধ সংগঠিত করে থাকে। এ চক্রটি সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন ব্যাংকে গ্রাহককে টার্গেট করে অপহরণপূর্বক অর্থ ছিনতাই করে আসছে।
জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানান, সাম্প্রতিক সময়ে চক্রটি ব্যাংকের গ্রাহকদের অপহরণ ও অর্থ ছিনিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে নানাবিধ কৌশল অবলম্বন করে। প্রথমত দলের ১ বা ২জন সাধারণ ছদ্মবেশে ব্যাংকের বাহিরে, ২ বা ৩ জন গ্রাহকের ছদ্মবেশে ব্যাংকে অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং মূল দলটি মাইক্রোবাসযোগে সুবিধাজনক স্থানে অপেক্ষা করতে থাকে। অতঃপর তারা সুবিধাজনক গ্রাহকদের সনাক্ত করতে চেষ্টা করে। যে গ্রাহক বেশি টাকা উত্তোলন করে কিন্তু নিজস্ব গাড়ি নেই সাধারণত তাদেরকে টার্গেট করে থাকে।
মুফতি জানান, একজন ব্যাংক থেকে বেরিয়ে হয়ে বাহিরের জনকে টার্গেট বুঝিয়ে দেয়। অথবা সরাসরি তারা মোবাইলের মাধ্যমে মূলদল বাহিরে অবস্থানরত দলকে অবহিত করে থাকে। সে সময় মাইক্রোবাসটি পেছন থেকে অথবা সামনে থেকে এসে সুবিধাজনক স্থানে ভিকটিমের গতিরোধ করে মাইক্রোবাসে তুলে ফেলে। পরে তারা গাড়ির ভিতরে ভিকটিমকে চোখমুখ বেঁধে চলন্ত মাইক্রোবাসে নির্যাতন করে সমস্ত টাকা ছিনিয়ে নেয় এবং ভিকটিমকে রাস্তায় ফেলে যায়।
দলটির সদস্যদের অপরাধকালীন সময়েকে র্যাবের অফিসারের ন্যায় ভূমিকায় কে থাকবে, কে হ্যান্ডকাফ পড়াবে, কে ব্যাংকের ভিতরে থাকবে, কে ব্যাংকের বাহিরে থাকবে কিভাবে ইশারায় যোগাযোগ করবে এসব দায়িত্ব পূর্ব থেকেই নির্ধারণ করা থাকে।
র্যাব মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান জানান, এদের মধ্যে- কাশেম ওরফে জীবন ব্যাপারী দলের প্রধান হিসেবে যাবতীয় বিষয়াদি তদারকি করে থাকে, ইব্রাহিম খলিল মাইক্রোবাসের ড্রাইভার, জাকির হোসেন সুমন ও বিল্লাল হোসেন আসলাম ভিকটিমকে ধরে মাইক্রোবাসে উঠানোর কাজ করে থাকে, আব্দুল মন্নান মাইক্রোবাসে তোলার পর চোখ বেধে ফেলার কাজ করে, সোহাগ মাইক্রোবাস অপেক্ষমান থাকাকালীন সময়ে গাড়ির নাম্বার প্লেট আড়াল করে দাড়িয়ে থাকে, আরিফ ভিকটিককে মাইক্রোবাসে তোলার পর পিছনে বসে লক্ষ্য রাখে অন্য কোন গাড়ি তাদেরকে ফলো করছে কি না। বিগত কয়েক মাসে এই সঙ্গবদ্ধ চক্রটি এ ধরণের অপরাধগুলো সংঘটিত করত বলে জানিয়েছে।
এসময় গত দুই মাসে তারা যে অপহরণ সংঘটিত করেছে তা স্বীকার করে র্যাবকে জানায়- হবিগঞ্জের মাধবপুর হতে একজন ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে ৩ লক্ষ টাকা। চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড হতে একজন ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে ১ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা,আশুলিয়া সাভার ইপিজেড এলাকা হতে ২ লক্ষ টাকা, কুমিল্লা চান্দিনা কাচা বাজার হতে একজনকে অপহরণ করে ১ লক্ষ টাকা, কেরানীগঞ্জ থানাধীন আটিপাড়া বাজার হতে ৭ লক্ষ টাকা, নরসিংদীর শিবপুর বাজার এলাকা হতে ১০ হাজার টাকা, মাদারীপুর শিবচর বাজার এলাকা হতে ২ লক্ষ টাকা, মানিকগঞ্জ পাটুরিয়া শিবালয় থানা এলাকা হতে ১ লক্ষ টাকা, টাঙ্গাইল মির্জাপুর হতে একজন ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে ৩ লক্ষ টাকা, সিরাজগঞ্জ জেলার নীমতলা বাজার জোড়াব্রীজ এলাকা হতে ২ লক্ষ টাকা, গাজীপুরের টঙ্গী হতে ২ লক্ষ টাকা, কুমিল্লার চৌদ্রগ্রাম মিয়ার বাজার হতে ৩ লক্ষ টাকা এবং কুমিল্লা চান্দিনা থানাধীন সেনানিবাস এলাকা হতে ৩ লক্ষ টাকা। গত দুই মাসে তারা সর্বমোট ৩০ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা অপহরণ করে নিয়েছে।
এবিষয়ে বিমানবন্দর থানায় আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।