ঢাকা বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১


ট্রেন দুর্ঘটনায় কত সুখের সংসার তাদের ভেঙে গেল আজ


১৩ নভেম্বর ২০১৯ ১১:০২

ছবি সংগৃহীত

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলায় দুই ট্রেনের সংঘর্ষে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৬ জনে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে হবিগঞ্জেরই সাতজন। এদের মধ্যে রয়েছে নারী ও শিশু। নিহতদের কেউ চাকরির সন্ধানে, কেউ সমুদ্র দেখতে, আবার কেউ কর্মস্থলে ফিরছিলেন। নিহতদের পরিবারে চলছে শোক। স্বজনদের কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে এলাকার পরিবেশ।

নিহত সাতজন হলেন হবিগঞ্জ শহরতলির বড় বহুলা গ্রামের আলমগীর আলমের ছেলে ইয়াছিন আরাফাত (১২), আনোয়ারপুর এলাকার বাসিন্দা ও জেলা ছাত্রদলের সহ-সভাপতি আলী মোহাম্মদ ইউসুফ (৩২), বানিয়াচং উপজেলার তাম্বুলিটুলা গ্রামের সোহেল মিয়ার আড়াই বছরের মেয়ে আদিবা আক্তার সোহা ওরফে সোহা মনি ও মদনমুরত গ্রামের আল-আমিন (৩০), চুনারুঘাট উপজেলার উবাহাটা গ্রামের পশ্চিম তালুকদার বাড়ির ফটিক মিয়া তালুকদারের ছেলে রুবেল মিয়া তালুকদার (২০), মিরাশী ইউনিয়নের পাকুড়িয়া গ্রামের আবুল হাসিম মিয়ার ছেলে সুজন মিয়া (৩০) ও একই উপজেলার আহমদাবাদ গ্রামের পিয়ারা বেগম (৩২)। উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনে চট্টগ্রাম যাচ্ছিলেন তারা।

ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহত ইয়াছিন আরাফাতের বাবা আলমগীর আলম আহত হন। তিনি হবিগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক ও বহুলা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি। তার ছেলে ওই বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ত। সে স্টুডেন্ট কাউন্সিলের নির্বাচিত সদস্য ছিল। ইয়াছিন বাবার সঙ্গে চট্টগ্রামে যাচ্ছিল সাগর ও দর্শনীয় স্থান দেখতে। ট্রেন দুর্ঘটনায় ছেলেকে হারিয়ে তার মা হাসিনা আক্তার বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন।

এদিকে, অনেক আগেই বাবা-মাকে হারিয়েছিলেন নিহত আল-আমিন। কোনো ভাই-বোনও ছিল না তার। বিয়ে করেছিলেন। সংসারে ছিল দুই মেয়ে, রনিহা (৬) ও নুছরা (৮)। ১৯ দিন আগে একটি ছেলে হয় তার। সেই ছেলের নাম রেখে আর কর্মস্থলে ফিরতে পারেননি আল-আমিন।

নিহত আল-আমিনের চাচা বানিয়াচংয়ের বড়ইউড়ি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক সদস্য কুতুব উদ্দিন জানান, আল-আমিন চট্টগ্রামে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করত। ১৯ দিন আগে তার এক ছেলের জন্ম হয়। ছেলের নাম রাখতে সম্প্রতি বাড়িতে আসে। একমাত্র ছেলের নাম রাখে ইয়ামিন। ছেলের নাম রেখে চাচা মনু মিয়া ও ফুফাতো ভাই শামীমকে নিয়ে সোমবার রাতে উদয়ন ট্রেনে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। কিন্তু রেল দুর্ঘটনায় সে মারা যায়। অপর দুজন মনু মিয়া ও শামীম গুরুতর আহত হন।

বন্ধুদের নিয়ে কক্সবাজারে বেড়াতে যাচ্ছিলেন চুনারুঘাটের উবাহাটা গ্রামের রুবেল মিয়া তালুকদার। তিনি ওই গ্রামের পশ্চিম তালুকদার বাড়ির ফটিক মিয়া তালুকদারের ছেলে। পড়তেন স্থানীয় শানখলা মাদরাসায়। কিন্তু কক্সবাজার আর যাওয়া হয়নি রুবেলের।

চুনারুঘাটের উবাহাটা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. রজব আলী জানান, রুবেলসহ একই এলাকার চার বন্ধু সোমবার রাতে শায়েস্তাগঞ্জ রেলওয়ে জংশন থেকে উদয়ন এক্সপ্রেসে করে কক্সবাজারে বেড়ানোর উদ্দেশ্যে রওনা হন। ট্রেন দুর্ঘটনার কবলে পড়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান রুবেল। বাকি চার বন্ধুর মধ্যে একজন গুরুতর আহত এবং বাকিরা অক্ষত।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালের মেঝেতে পড়েছিল শিশুটির নিথর দেহ। ফুটফুটে সুন্দর শিশুটি। পোশাক-আশাক পরিপাটি। শিশুটিকে একনজর দেখতে এসে অনেকেই চোখের পানি ছাড়েন। শিশুটির পাশে কেউ ছিল না। তার মা-বাবা ও ভাই ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ঢাকার হাসপাতালে ভর্তি।

শিশুটির নাম আদিবা আক্তার সোহা। বয়স তিন বছর। সে হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার বড়বাজারের তাম্বুলিটুলা গ্রামের সোহেল মিয়া ও নাজমা বেগমের মেয়ে। সোহেল, নাজমা ও তাদের আহত ছেলেকে প্রথমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, পরে হবিগঞ্জ এবং সেখান থেকে ঢাকায় পাঠানো হয়।

সোহেল মিয়া জানান, তিনি ও তার স্ত্রী নাজমা বেগম চট্টগ্রামের একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। গত বৃহস্পতিবার তারা হবিগঞ্জের বাড়ি আসেন। কর্মস্থলে যেতে সোমবার রাতে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে তারা সিলেট থেকে ছেড়ে আসা চট্টগ্রাম অভিমুখী উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনে ওঠেন। পথে ট্রেন দুর্ঘটনায় তার মেয়ে সোহা মারা যায়। আহত হন তিনি, তার স্ত্রী ও সাড়ে চার বছর বয়সী ছেলে নাসির। তারা এখন ঢাকায় চিকিৎসাধীন।

হবিগঞ্জ শহরের আনোয়ারপুর গ্রামের আবদুল আহাদ জানান, তার চাচাতো ভাই আলী মোহাম্মদ ইউসুফ বৃন্দাবন সরকারি কলেজ থেকে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে মাস্টার্স সম্পন্ন করে স্থানীয় একটি কিন্ডারগার্টেনে অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তার স্ত্রী চিশতিয়া বেগম চট্টগ্রামে স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে কর্মরত। স্ত্রী ও দেড় বছর বয়সী একমাত্র মেয়ে ইশা আক্তারকে বাড়িতে আনতে চট্টগ্রামে যাচ্ছিলেন। ট্রেন দুর্ঘটনায় তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান।

ট্রেন দুর্ঘটনায় জেলা ছাত্রদলের সহ-সভাপতি আলী মোহাম্মদ ইউসুফের নিহত হওয়া প্রসঙ্গে কমিটির সাধারণ সম্পাদক রুবেল আহমেদ চৌধুরী বলেন, নিহত আলী মোহাম্মদ ইউসুফ জেলা ছাত্রদলের সহ-সভাপতি ছিলেন। তিনি চার ভাই বোনের মধ্যে তৃতীয়। তার বাবা মারা গেছেন ২০১১ সালে। বড় ভাই উসমান গনি ২০১৭ সালে ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ইউসুফই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী।

চুনারুঘাট উপজেলার পাকুড়িয়া গ্রামের সুজন মিয়া চাকরির ইন্টারভিউ দিতে চট্টগ্রামে যাচ্ছিলেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ট্রেন দুর্ঘটনায় তিনি নিহত হয়েছেন। তিনি হবিগঞ্জ সরকারি বৃন্দাবন কলেজের স্নাতকের ছাত্র ছিলেন। পাশাপাশি তিনি হবিগঞ্জ আদালতে মোহরার হিসেবে কাজ করতেন। তিনি ওই গ্রামের আবুল হাসিম মিয়ার ছেলে। চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট।

চুনারুঘাটের আহমদাবাদ ইউনিয়নের ছয়শ্রী গ্রামের আবদুস সালামের স্ত্রী পিয়ারা বেগম সোমবার রাতে বাবার বাড়ি যাচ্ছিলেন। একাই তিনি বাড়ি থেকে রওনা হন। পথে ট্রেন দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান। তার চার সন্তান রয়েছে। খবর পেয়ে সকালে তার স্বামী আব্দুস সালাম লাশ আনতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যান। এ বিষয়টি জানিয়েছেন আহমদাবাদ ইউপি চেয়ারম্যান আবুল হাসনাত চৌধুরী।

এদিকে, নিহতদের পরিবারকে তাৎক্ষণিক ১৫ হাজার টাকা করে সহায়তা দিয়েছে জেলা প্রশাসন। আর এক ছাত্রদল নেতা নিহত হওয়ায় বিএনপি পরিবারেও নেমে এসেছে শোকের ছায়া।

হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. কামরুল হাসান বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত হবিগঞ্জের সাতজন নিহত হওয়ার খবর নিশ্চিত হয়েছি। নিহতদের পরিবারের খোঁজখবর রাখার জন্য প্রত্যেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আহতদের বিষয়ে তথ্য নিতে বলা হয়েছে। তাৎক্ষণিক নিহতদের দাফনের জন্য ১৫ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে। আহতদের তথ্য সংগ্রহের পর চিকিৎসা সহায়তা দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করা হয়েছে।

বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সমবায় বিষয়ক সম্পাদক জি কে গউছ বলেন, ট্রেন দুর্ঘটনা এমনিতেই হয়নি। কারও না কারও গাফিলতি ছিল। বিষয়টি সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক। এমন মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত।

হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মিজানুর রহমান মিজান বলেন, ছাত্রদল নেতা ইউসুফের মৃত্যুতে আমি এবং আমার পৌর পরিষদ শোকাহত। তার পরিবারের যে ক্ষতি হয়েছে তা কারও পক্ষে পূরণ করা সম্ভব নয়। ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহত সবার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।