সরকারি সকল বড় কাজ ছিল যুবলীগ নেতা শামীমের কবজায়
তিনটি মোটরসাইকেলে ছয়জন দেহরক্ষী নিয়ে যুবলীগ নেতা জি কে শামীম চলাফেরা করতেন গডফাদারের মতো। সঙ্গে তার বহরে থাকত অন্তত তিনটি গাড়ি।
সাইরেন বাজাতে বাজাতে রাস্তা অতিক্রম করতেন। গাড়ি থামার সঙ্গে সঙ্গে দেহরক্ষীরা তাকে নিরাপত্তার নামে চারদিক থেকে ঘিরে রাখতেন। রাজধানীর নিকেতন এলাকায় তিনি প্রবেশ করলেই সবাই তাঁর উপস্থিতি টের পেতেন।
এই মহাক্ষমতাধর ব্যক্তির নাম এস এম গোলাম কিবরিয়া ওরফে শামীম। নিজের নাম সংক্ষেপ করে বলতেন জি কে শামীম। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জি কে বিল্ডার্সের মালিক তিনি। নিজেকে পরিচয় দিতেন যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সমবায়বিষয়ক সম্পাদক বলে।
গতকাল শুক্রবার র্যাব সদস্যরা রাজধানীর নিকেতনে তার কার্যালয়ে গতকাল অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা, স্থায়ী আমানতের (এফডিআর) কাগজপত্র, অস্ত্র ও মদ জব্দ করেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ সময় তার কার্যালয়ে হানা দিয়ে তাকে ও তার সাত দেহরক্ষীকে গ্রেপ্তার করেন।
একে একে টাকার বান্ডিল বের করে দিচ্ছেন যুবলীগ নেতা জি কে শামীম। এরপর সেখান থেকে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা, ১৬৫ কোটি টাকার স্থায়ী আমানতের (এফডিআর) কাগজপত্র (তাঁর মায়ের নামে ১৪০ কোটি), ৯ হাজার ইউএস ডলার, ৭৫২ সিঙ্গাপুরি ডলার, একটি আগ্নেয়াস্ত্র এবং মদের বোতল জব্দ করা হয়েছে।
র্যাব বলছে, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ এবং চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এই অভিযান।
এদিকে গতকাল সন্ধ্যায় কলাবাগান ক্রীড়া চক্র ও ধানমন্ডি ক্লাবে অভিযান চালায় র্যাব। অভিযান শুরুর আগে কলাবাগান ক্লাবের সভাপতি অস্ত্রসহ শফিকুল আলমকে আটক করা হয়। শফিকুল স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা হিসেবে পরিচিত। এ ছাড়া ধানমন্ডি ক্লাবের বার সিলগালা করে দেয় র্যাব।
র্যাবের অভিযানের সময় শামীমের ঠিকাদারি কার্যালয়ে ঢুকেই দেখা গেল, অভ্যর্থনাকক্ষের দেয়ালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা মো. কাওসার, র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ, আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহানের সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শামীমের অন্তরঙ্গ ছবি টানানো। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ের গাড়ি পার্কিংয়ের পর নকশাখচিত দুই পাল্লার দরজা পেরিয়ে ভবনটির যত ভেতরে ঢোকা গেল, ততই জৌলুশ চোখে পড়ে।
তৃতীয় তলায় প্রায় ৩০ ফুট লম্বা ও ২০ ফুট চওড়া শামীমের বসার কক্ষটি দামি বাতি, কাঠ দিয়ে সাজানো। বড় আকারের দুটি টিভি, তিন সেট সোফা ও একটি বড় টেবিল রয়েছে সেই কক্ষে। সেই টেবিলের ওপরই গতকাল র্যাব তাঁর কাছ থেকে জব্দ করা টাকার বান্ডিল, মদের বোতল ও অস্ত্র সাজিয়ে রেখেছিল।
গত বুধবার যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গুলশানে তাঁর নিজ বাসা থেকে আটক করে র্যাব। একই দিন ফকিরাপুলের ইয়ংমেনস ক্লাবে তাঁর পরিচালিত অবৈধ ক্যাসিনোতেও অভিযান চালানো হয়। খালেদের গ্রেপ্তারের পরপরই শামীমের নাম আলোচনায় আসে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান অনেক নেতাই তাঁকে নিয়ে মন্তব্য করেন। হাতে আগ্নেয়াস্ত্র থাকা ছয় দেহরক্ষীসহ তার একটি ছবি ছড়িয়ে পড়ে।
অভিযানে থাকা র্যাব সদর দপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম বলেন, শামীমের মায়ের কোনো ব্যবসা নেই। তারপরও তার নামে ১৪০ কোটি টাকার এফডিআর পাওয়া গেছে। তার দেহরক্ষীরা অস্ত্র প্রদর্শন করে বিভিন্ন জায়গা থেকে সুবিধা নিতেন। বৈধ কাজের আড়ালে কোনো অবৈধ কাজ করা হচ্ছিল কি না, সেই বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হবে।
তবে শামীমকে গ্রেপ্তারের পর যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী, নারায়ণগঞ্জের সাংসদ শামীম ওসমান, যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী, সাবেক ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়ের সঙ্গে তার বিভিন্ন সময়ের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
নতুনসময়/এস