শুদ্ধি অভিযানে এবার যুবলীগের পালা
দলে বড়ো ধরনের শুদ্ধি অভিযানে শুরু করতে যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। ছাত্রলীগের পর এবার যুবলীগের পালা। আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত এ অভিযান চলবে। দখল-চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি-অস্ত্রবাজি-ক্যাডারবাজিসহ নানা অপকর্মে জড়িত সারাদেশের যুবলীগের ৫০০ নেতাকর্মীর তালিকা এখন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে। বিভিন্ন গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যরা প্রমাণসহ এ তালিকা জমা দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
এমন প্রেক্ষাপটে যুবলীগের কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যারা অস্ত্রবাজি করেন, ক্যাডার পোষেণ, তারা সাবধান হয়ে যান। এসব বন্ধ করুন। নইলে যেভাবে কঠোরভাবে জঙ্গি ও মাদক ব্যবসায়ীদের দমন করা হয়েছে, একইভাবে এই অস্ত্রবাজদেরও দমন করা হবে। পাশাপাশি দলীয় ও সরকারের দায়িত্বশীল পদে যারা আসীন আছেন, তাদেরও আত্ম অহমিকা ও ক্ষমতার জোরে দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত না হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। গত শনিবার গণভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি এই কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। দলীয় বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়।
জানা গেছে, ঐ বৈঠকে যুবলীগ প্রসঙ্গে আলোচনার অবতারণা করেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও যুবলীগের সাবেক চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির নানক। বৈঠকের এজেন্ডায় উল্লেখ থাকা শেখ হাসিনার জন্মদিন পালনের আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি যুবলীগের পক্ষ থেকে শেখ হাসিনার জন্মদিন পালন উপলক্ষ্যে মাসব্যাপী কর্মসূচির কথা তুলে ধরেন। পরে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, শনিবার যুবলীগ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষ্যে মিলাদ, দোয়া মাহফিল ও আলোচনা সভা করেছিল। তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
এরপর প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কীসের টাকা বৈধ করতে মিলাদ মাহফিল করা হয়েছে? চাঁদাবাজির টাকা বৈধ করতে মিলাদ মাহফিল!’ নিজের জন্য এমন মিলাদ মাহফিল তিনি চান না। শেখ হাসিনা আরো বলেন, ‘যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের একজন সাংগঠনিক সম্পাদক এখন দিনের বেলায় প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে চলেন। এসব বন্ধ করতে হবে। যখন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে, তখন কেউ অস্ত্র নিয়ে বের হননি, অস্ত্র উঁচিয়ে প্রতিবাদ করেননি। যখন দলের দুঃসময় ছিল, তখন কেউ অস্ত্র নিয়ে দলের পক্ষে অবস্থান নেননি। এখন টানা তিনবার সরকারে আছি। অনেকের অনেক কিছু হয়েছে, কিন্তু আমার সেই দুর্দিনের কর্মীদের অবস্থা একই আছে।’
ছাত্রলীগের সদ্য অব্যাহতি পাওয়া সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর সঙ্গে তুলনা করে যুবলীগের কিছু নেতার উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এরা আরও খারাপ।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুবলীগের ঢাকা মহানগরের একজন নেতা (ঢাকা মহানগর যুবলীগের একটি অংশের সভাপতি) ক্রসফায়ার থেকে বেঁচে গেছেন। আরেকজন (মহানগর দক্ষিণের একজন সাংগঠনিক সম্পাদক) এখন দিনের বেলায় প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে চলেন। সদলবলে অস্ত্র নিয়ে ঘোরেন। এসব বন্ধ করতে হবে।
উল্লেখ্য, গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের কমিটি ভেঙে দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। রাজধানীর কাকরাইলে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের ভবন নির্মাণের কাজে যুবলীগ দক্ষিণের শীর্ষ এক নেতার নামে চাঁদা দাবি ও কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ পান শেখ হাসিনা। এরই ভিত্তিতে ক্ষুব্ধ হয়ে কমিটি ভেঙে দেওয়ার নির্দেশ দেন তিনি। এই চাঁদাবাজ গ্রুপকে র্যাব দিয়ে ধরিয়ে দেবেন বলেও হুঁশিয়ারি দেন শেখ হাসিনা। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের যে সাংগঠনিক সম্পাদকের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী কথা বলেছেন, তিনি ব্যাংক ডাকাতি, হত্যাসহ অনেক মামলার আসামি। শহীদবাগে হোটেলে গুলি করে অস্ত্রসহ গ্রেফতার হয়ে কারাবাসও করেন যুবলীগের ঐ নেতা।
জানা গেছে, কাওরানবাজার এলাকায় যুবলীগের এক নেতা দাপটের সঙ্গে চাঁদাবাজি করে যাচ্ছেন। তাঁর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল তার রুম থেকে যুবলীগের ঐ নেতাকে বেরও করে দেন। কেন্দ্রীয় যুবলীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য ছাত্রজীবনেই স্বীকৃতি পেয়েছিলেন চাঁদাবাজ ও টেন্ডারবাজ হিসেবে। ২০০০ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় শিক্ষা ভবনে টেন্ডারবাজি করতে গিয়ে পিটুনি খেয়েছিলেন তিনি। গ্রেফতার অবস্থায় পত্রিকায় তার ছবি ছাপা হয়েছিল। এরপর রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়েছে। আবারও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু শিক্ষা ভবন ছাড়েননি সেই নেতা।
যুবলীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, বিভিন্ন সরকারি সংস্থার প্রধান কার্যালয়, এমনকি সচিবালয়ের ভেতরে মন্ত্রণালয় পর্যন্ত যুবলীগ নেতাদের আনাগোনা। রাজনৈতিক প্রতিপত্তি, নিজস্ব মাস্তান বাহিনী এবং টাকা ছড়িয়ে তারা সব ধরনের ঠিকাদারি ও সরবরাহ কাজ হস্তগত করেছেন। আর দলের ঠিকাদারদের মধ্যে বিবাদ তৈরি হলে সমঝোতার জন্য রয়েছেন বড়ো নেতারা। তবে কাজ যে-ই পাক, নেতাদের কমিশনের টাকা পৌঁছে দিতে হয় শতাংশ হিসেবে। এদিকে রাজধানীর বিভিন্ন ক্লাবে জুয়ার আসর থেকে যুবলীগ নেতারা বিশাল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। মহানগর যুবলীগের কয়েক জন নেতা জুয়া খেলে ও জুয়ার আসর বসিয়েই ধনী হয়েছেন এবং রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। ঐসব নেতা জুয়া খেলতে আমেরিকার লাস ভেগাস ও সিঙ্গাপুরে যান বলেও অভিযোগ রয়েছে।
সূত্র জানায়, ছাত্রলীগ থেকে সদ্য অব্যাহতি পাওয়া রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী বিষয় ক্ষোভ প্রকাশ করে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি ওদের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক বানালাম, কিন্তু ওরা পদ পাওয়ার পর ‘মনস্টার’ হয়ে গেছে। এদের আর ছাত্রলীগের নেতৃত্বে থাকার দরকার নেই। এরপরই তিনি শোভন-রাব্বানীকে অব্যাহতি দিয়ে আল নাহিয়ান খান জয়কে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও লেখক ভট্টাচার্যকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়ার কথা ঘোষণা দেন। প্রসঙ্গত, ছাত্রলীগের ৭১ বছরের ইতিহাসে চাঁদাবাজির অভিযোগে মেয়াদ পূর্তির ১১ মাস আগেই এক সঙ্গে কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পদত্যাগ বা অব্যাহতির ঘটনা এই প্রথম।