সাভারে ডাকাত দলের সর্দার, লেগুনা আপেল অবশেষে নারায়ণগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার

ঢাকার সাভারে ষষ্ঠ শ্রেণী পাস না করেই বাবার পেশা কসাই ও লেগুনার ড্রাইভার হিসেবে পেশা শুরু করে পরবর্তীতে ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি, পাঁচ নারীকে ধর্ষণসহ নানা ধরনের অপরাধের সাথে যুক্ত হয়ে এক সময় আন্তজেলা ডাকাত দলের সদস্য হন আপেল মাহমুদ ওরফে লেগুনা আপেল।
দীর্ঘদিন পর এ পেশায় অপকর্ম করে খ্যাতি হিসেবে ডাকাত দলের সর্দার হিসেবে নিযুক্ত হন। পরবর্তীতে "আপেল ভাইয়ের দল" নামে একটি ডাকাত দল গড়ে নিজেকে নতুন নামে আত্মপ্রকাশ করেন। গ্রেপ্তার হয়ে কারাবাস শেষে জামিনে মুক্ত হয়ে আওয়ামী পন্থী আজকের সংবাদ নামে একটি আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার সাভার প্রতিনিধি বনে যান তিনি। শুরু করেন কথিত সাংবাদিকতার নামে মানুষকে ব্ল্যাকমেইল ও চাঁদাবাজি।
পরবর্তীতে সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান শীর্ষ সন্ত্রাসী মঞ্জুরুল আলম রাজীবের দলে যোগ দেন আপেল মাহমুদ ওরফে লেগুনা আপেল। এরপর রাজীবের মালিকানাধীন রাজ গ্রুপের সহায়তায় বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল মাই টিভিতেও সাভার প্রতিনিধির পদ বাগিয়ে নেন এই প্রতারক। তবে প্রতিনিধিত্ব পাওয়ার ৪ মাসের মাথায় শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যা, বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের বাড়িতে ডাকাতিসহ নানা অপকর্মের ফিরিস্তি উঠে আসতে শুরু করলে অবস্থা বেগতিক দেখে ঘোষণা দিয়ে লেগুনা আপেলের প্রতিনিধিত্ব বাতিল করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আপেলকে গ্রেপ্তারের অনুরোধ জানায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত মাই টিভি চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন সাথী।
অবশেষে দীর্ঘদিন পলাতক থাকার পর ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে শহীদ পরিবারের দায়ের করা দুই ডজন হত্যা মামলার এজাহার ভুক্ত আসামী এবং আটজন পেশাদার সাংবাদিককে হত্যা চেষ্টাকারী, পাঁচ নারীকে ধর্ষণকারী, ৫ বিএনপি নেতার বাড়িতে ডাকাতির অভিযোগে অভিযুক্ত নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ও আন্তজেলা ডাকার দলের সর্দার আপেল মাহমুদ ওরফে লেগুনা আপেলকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
রবিবার (১৩ এপ্রিল) দুপুরে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট এলিট ফোর্স র্যাবের সহায়তায় অভিযান পরিচালনা করে সাভার মডেল থানা পুলিশ। একটি ভাড়া বাসায় অভিযান চালিয়ে নারায়ণগঞ্জ এলাকা থেকে আপেল মাহমুদ ওরফে লেগুনা আপেলকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তিনি সাভার পৌরসভার ভাটপাড়া মহল্লার শুকুর মুন্সি ওরফে শুকরু কসাইয়ের ছেলে। গ্রেফতারকৃত আপেল মাহমুদ সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলম রাজীব ওরফে বিচি বাবার ঘনিষ্ঠ সহযোগী।
রবিবার বিকালে আপেল মাহমুদ ওরফে লেগুনা আপেলকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করে এ তথ্য জানিয়েছেন সাভার মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ জুয়েল মিঞা।
পুলিশ জানায়, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে নিহতদের স্বজনরা বেশ কিছু মামলা করেছেন। এই মামলায় এজাহারভুক্ত আসামী আন্তজেলা ডাকাত দলের সর্দার কথিত সাংবাদিক আপেল মাহমুদ। ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে গত বছরের ৫ আগষ্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে প্রথমে শশুর বাড়ি পাবনা, পরে বগুড়া ও সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জে আত্মগোপনে ছিলেন পলাতক এই অপরাধী।
বারবার স্থান পরিবর্তন করায় ৫ দিন অপেক্ষার পর রবিবার (১৩ এপ্রিল) দুপুরে তথ্য প্রযুক্তির সাহায্যে সাভার মডেল থানা পুলিশের বিশেষ অভিযানে নারায়ণগঞ্জের একটি ভাড়া বাসা থেকে আপেল মাহমুদ ওরফে লেগুনা আপেলকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এ ব্যাপারে সাভার মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ জুয়েল মিঞা বলেন, ‘সাংবাদিকতার আড়ালে আপেল মাহমুদ ওরফে লেগুনা আপেলের মতো আওয়ামী সন্ত্রাস প্রেমী এ ধরনের অপরাধীদের ধরা শুরু হয়েছে, একে একে এসব অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হবে। আপেলের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহত পরিবারের পক্ষ থেকে একাধিক হত্যা মামলা করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদের প্রস্তুতি চলছে।
উল্লেখ্য, সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান শীর্ষ সন্ত্রাসী মঞ্জুরুল আলম রাজীবের নানা অপকর্মের তথ্য গণমাধ্যমে তুলে ধরতেন সাভারের স্থানীয় সাংবাদিক মতিউর রহমান ভান্ডারী, সোহেল রানাসহ অন্য সাংবাদিকরা। পাল্টা রাজীবের পক্ষ নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ফেসবুকে অপপ্রচার করতেন আপেল মাহমুদ ওরফে লেগুনা আপেল। রাজীবকে খুশি করতে গত বছরের ১৫ই মে সাংবাদিক সোহেল রানার বিরুদ্ধে আদালতে মিথ্যা মামলা করিয়ে পুরস্কার স্বরূপ বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের প্রতিনিধিত্ব ও সাভার উপজেলা থেকে তিন মাসে ৬ লাখ টাকার বিজ্ঞাপন বাগিয়ে নেন আপেল মাহমুদ।
এছাড়াও সাভার প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও দৈনিক ফুলকির সম্পাদক নাজমুস সাকিবের বিরুদ্ধে গুজব ছড়িয়ে হয়রানি, সাভার প্রেসক্লাবের বিরুদ্ধে অপপ্রচার, সাংবাদিক ইমদাদুল হক ও রওশন আলীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার, সাংবাদিক আব্দুস সালাম, মবিনুর রহমান, শামীম হোসেনকে মামলা দিয়ে হয়রানি ও হত্যাচেষ্টা, সাংবাদিক সুফিয়ান ফারাবীকে নির্যাতন ও কাজী রেজাউল করিমকে হত্যাচেষ্টা, মানবাধিকার কর্মী সোনাম উদ্দিনকে নির্যাতন করে হত্যাচেষ্টা, সাভার পৌরসভার জামসিং এলাকার এক গৃহবধূকে ধর্ষণ করে আপত্তিকর ভিডিও ধারণের পর ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল ও বাধা দেওয়ায় গৃহবধূর বাবা ইসমাইল হোসেন, গৃহবধুর ছোট ভাই ও প্রবাসী স্বামীকে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি ও নির্যাতন, সাভার পৌরসভার ভাটপাড়া কাঠালবাগান এলাকার গার্মেন্টস কর্মী দুই বোনকে ধর্ষণ, রেডিও কলোনি এলাকার নয়াবাড়ি মহল্লার এক কিশোরীকে ধর্ষণ, তিতাস গ্যাসের এক ঠিকাদারের মেয়েকে অপহরণ করে ধর্ষণ ও পরে জোরপূর্বক বিয়ে, সাভার উপজেলার বিরুলিয়া ইউনিয়নের একটি মসজিদের দুই পক্ষের বিবাদ মেটাতে গিয়ে টাকা চুরি করে আত্মসাত, জুলাই আন্দোলন চলাকালীন সময়ে বিএনপি নেতা খোরশেদ আলমের বাড়িতে ডাকাতি, ক্যামেরা পার্সন নয়নের ক্যামেরা ছিনতাই, ব্যবসায়ী নেতা ওবায়দুর রহমান অভির বাড়িতে ডাকাতি, বিএনপি নেতা আব্দুর রহমানের বাড়িতে ডাকাতি, দৈনিক ফুলকি অফিসে ভাঙচুর ও লুটপাট, চাঁদা না পেয়ে ভাটপাড়া এলাকার বিকাশ দোকানদার দেলোয়ার হোসেনকে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার মামলা দিয়ে হয়রানি, জুলাই আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্র-জনতাকে প্রকাশ্যে মারধর ও আটকে রেখে নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে আপেল মাহমুদ ওরফে লেগুনা আপেলের বিরুদ্ধে। ডাকাতি ও মারধরের ঘটনায় নেতৃত্ব দিয়েছেন এই প্রতারক।
প্রসঙ্গত, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীরা জুলাই ও আগষ্ট মাসে সাভার ও আশুলিয়ার বাইপাইলে জমায়েত হতে থাকেন। এ সময় স্বৈরাচার শেখ হাসিনার অন্যতম সহযোগী সাভার উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান শীর্ষ সন্ত্রাসী মঞ্জুরুল আলম রাজীব ওরফে বিচি বাবা এবং ঢাকা-১৯ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলাম ওরফে ডিম সাইফুলের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। এ ঘটনায় সাভার আশুলিয়ায় শতাধিক ছাত্র-জনতা শহীদ হন। শহীদের স্বজনরা পরবর্তীতে মামলা করেন। এসব মামলায় আসামিদের ধরতে তৎপর রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।