ঢাকা সোমবার, ২১শে এপ্রিল ২০২৫, ৮ই বৈশাখ ১৪৩২


ইসরায়েলে ৭ অক্টোবর যেভাবে হামলা করেছিল হামাস


৭ অক্টোবর ২০২৪ ১০:৪৪

ফাইল ফটো

ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে চলা গাজা যুদ্ধের এক বছর পূর্ণ হয়েছে আজ। ইসরায়েলি বাহিনীর টানা হামলার ঘটনা বর্বরতার রেকর্ড ভঙ্গ করেছে।

ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে গত বছরের ৭ অক্টোবর নজিরবিহীন হামলা চালান ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ সংগঠন হামাসের যোদ্ধারা। ইসরায়েলের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাণক্ষয়ী দিনটি ঘিরে খোদ দেশটির ভেতরে কঠিন সব প্রশ্ন উঠছে। ছয় ঘণ্টার ওই অভিযানে দেশটির শক্তিশালী সেনাবাহিনী অপ্রস্তুত এবং দ্রুতই বিহ্বল হয়ে পড়েছিল। 

 

সংবাদমাধ্যম বিবিসি তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের সীমান্তে হামলা চালিয়ে দেশটির ভূখণ্ডে প্রবেশ করে হামাস এবং তাদের মিত্র গোষ্ঠী প্যালেস্টাইনিয়ান ইসলামিক জিহাদের (পিআইজে) অন্তত এক হাজার সশস্ত্র যোদ্ধা। সেখানে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে ১ হাজার ২০৫ জনকে হত্যা করে তারা। নিহতদের অধিকাংশই বেসামরিক। সেই সঙ্গে জিম্মি হিসেবে ২৪২ জনকে ধরে নিয়ে যায় যোদ্ধারা। এই জিম্মিদেরও বড় অংশ বেসামরিক।

 

১৯৪৭ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামলা ছিল রাষ্ট্রটির ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা। হামাসের সেই হামলার জবাব দিতে এবং জিম্মিদের উদ্ধার করতে ওই দিন থেকেই গাজায় অভিযান শুরু করে ইসরায়েলি বাহিনী, যা এখনও চলছে। গত এক বছরে ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযানে গাজায় নিহত হয়েছেন প্রায় ৪২ হাজার ফিলিস্তিনি এবং আহত হয়েছেন আরো প্রায় এক লাখ।

 

যেভাবে হামলা করেছিল হামাস

 

গাজার সীমান্তবেড়া থেকে নাহাল ওজ ঘাঁটি এক কিলোমিটার দূরে ছিল। ৭ অক্টোবর ভোর চারটায় নিজের পালার দায়িত্ব পালন শুরু করেন নারী সেনাসদস্য শ্যারন (এটা তার প্রকৃত নাম নয়)। ওই ঘাঁটির ‘তাৎজপিতানিয়ত’ শাখার সদস্য ছিলেন তিনি। এই শাখার সব সদস্যই নারী। সীমান্তবেড়ার সঙ্গে বসানো নজরদারি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যালোচনা করা ছিল তাদের কাজ।

 

এই নারী সেনা সদস্যরা পালা করে ‘হামাল’ নামে পরিচিত ঘাঁটির যুদ্ধকক্ষে বসে কাজ করতেন। সেখানে থাকা মনিটরের মাধ্যমে ২৪ ঘণ্টা গাজার পরিস্থিতির ওপর নজর রাখতেন।

 

ওই ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের পরিবারগুলোকে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী বলেছে, ওই দিন ঘাঁটিতে অনেক সামরিক সদস্য নিরস্ত্র ছিলেন।

 

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর অপারেশন ডিভিশনের সাবেক প্রধান জেনারেল ইসরায়েল জিভ বলেন, তার দায়িত্ব পালনের সময় সীমান্ত এলাকায় কখনো সেনারা নিরস্ত্র ছিলেন না।

 

নাহাল ওজ ঘাঁটির সশস্ত্র কর্মীদের মধ্যে ওই দিন ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর গোলানি ব্রিগেডের এক ইউনিট পদাতিক সেনা ছিল।

 

অন্যান্য দিনের মতো সকাল হওয়ার আগে ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে সীমান্তের ইসরায়েলি অংশে গাড়িতে করে টহল দেওয়ার প্রস্তুতি নেন গোলানি ইউনিটের সদস্যরা। কিন্তু তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা টহল বিলম্বে শুরু করার এবং ট্যাংক–বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঝুঁকি থাকায় পিছু হটার নির্দেশনা দেন। ওই সেনাদলের তিনজন এমন কথা জানিয়েছেন।

 

একজন বলেন, ‘সতর্কতার বিষয় ছিল। সীমান্তের দিকের পথে অগ্রসর হতে নিষেধ করা হয়েছিল।’ গোলানি ইউনিটের আরেক সদস্য ২১ বছর বয়সী শিমন মালকা বলেন, এ ধরনের সতর্কতা ছিল অস্বাভাবিক, আগে কখনো এমনটা শোনা যায়নি। বিষয়টি কিছুটা চিন্তায় ফেলে দেয়।

 

জেনারেল জিভ বলেন, দাপ্তরিক নিয়মের কারণে সম্ভাব্য হামলার লক্ষ্যবস্তু হওয়া এড়াতে এ ধরনের পিছু হটার নির্দেশনা ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর নিয়মের মধ্যে পড়ে। তবে তিনি বলেন, হামাস বিষয়টি বুঝতে পেরেছিল এবং এ সুযোগ কাজে লাগিয়েছিল।

 

গোলানি ইউনিটের সদস্যরা যখন সীমান্তে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন, হামাস যোদ্ধাদের চলাফেরা শ্যারনের নজরে পড়ে। তবে বিষয়টি অন্য কয়েকটি দিনের চেয়ে আলাদা কিছু মনে হয়নি।

 

সকাল ৬টা ২০ মিনিটের দিকে রকেট ছুড়তে শুরু করে হামাস। কিন্তু শ্যারন আবারও বললেন, এটি তাৎক্ষণিক সতর্ক করার মতো কিছু মনে হয়নি। এ ধরনের রকেট হামলা দেখতে আগে থেকেই তিনি অভ্যস্ত এবং এসব রকেট থেকে ঘাঁটিটি ভালোভাবেই সুরক্ষিত।

 

শ্যারন বলেন, সাধারণত পাঁচ মিনিট ধরে রকেট ছোড়া হয় এবং এরপর বিরতি দেওয়া হয়। এবার কিন্তু কোনো বিরতি দেওয়া হচ্ছিল না।

 

সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে শ্যারন দেখতে পান, হামাসের বাহিনী সীমান্তের কাছে আসতে শুরু করেছে। এ সময় স্থলবাহিনীকে সতর্ক করতে রেডিওতে বার্তা পাঠাতে শুরু করেন এই তাৎজপিতানিয়ত সদস্য।

 

সীমান্তের কথিত লোহার প্রাচীরটি দীর্ঘকাল ধরে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী ও সাধারণ ইসরায়েলিরা দুর্ভেদ্য হিসেবে দেখেছিল। অথচ দেশটির ঘাঁটিগুলোই তখন সে প্রাচীর ভেঙে ফেলার খবর দিতে শুরু করেছিল। ওই পালায় নাহাল ওজ ঘাঁটিতে দায়িত্ব পালন করা প্রত্যেক তাৎজপিতানিয়ত সীমান্তবেড়ার দুটি থেকে পাঁচটি জায়গায় বেড়া ভেঙে ফেলতে দেখেন। 

 

নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের দেওয়া ইসরায়েলি বাহিনীর বক্তব্য অনুযায়ী, ৬টা ৪০ মিনিটের দিকে রকেটের আঘাতে নাহাল ওজ ঘাঁটির একটি নজরদারি পোস্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হামালের ওপর স্নাইপারদের অবস্থান নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। দূর থেকে বন্দুকধারীদের গুলি করার চেষ্টা করেন একজন কর্মকর্তা।

 

যুদ্ধকক্ষে তাৎজপিতানিয়তের সঙ্গে যোগ দেন পদাতিক কর্মকর্তারা। শ্যারনের যতদূর মনে পড়ে, একজন কমান্ডার সামরিক পোশাক পুরোপুরি না পরেই সেখানে যান। বন্দুকধারীরা একের পর এক নজরদারি ক্যামেরায় গুলি করতে থাকলে যুদ্ধকক্ষের মনিটরের স্ক্রিন কালো হয়ে যায়।

 

সকাল ৭টার কিছুক্ষণ পরে সেই ক্ষণ এসে হাজির। সবাই ভীতসন্ত্রস্ত। কী হতে যাচ্ছে, কেউই কল্পনা করতে পারছিল না। যুদ্ধ কক্ষের দরজায় এসে হাজির হামাসের বন্দুকধারীরা। তাৎজপিতানিয়ত শাখার সদস্যদের নিজেদের অবস্থান থেকে সরে এসে যুদ্ধকক্ষের ভেতরের একটি কার্যালয়ে যেতে বলা হয়।

 

সকাল ৭টা ২০ মিনিটের দিকে যুদ্ধকক্ষের বাইরের একটি বোম্ব শেল্টারে হামলা চালানো হয়। সেখানে অন্যদের মধ্যে দায়িত্বে না থাকা তাৎজপিতানিয়ত সদস্যরাও ছিলেন।

 

সকাল ৮টার দিকে যুদ্ধকক্ষে হামলা শুরু হয়, ব্যাপক গুলি করা হয়। যাদের হাতে অস্ত্র ছিল, তারা ভবনের দরজায় লড়ছিলেন, যাতে হামাস সদস্যরা ভেতরে প্রবেশ করতে না পারেন। প্রায় চার ঘণ্টা লড়াই চলতে থাকে।  

 

শিমন বলেন, তিনি এবং অন্য সেনারা ঘাঁটিতে লড়তে থাকেন, সেখানে তাদের সংখ্যা খুবই কম। অতিরিক্ত সেনা পাঠানোর কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। সবকিছু ধোঁয়াশা ঠেকছিল। 

 

সকাল ৯টার দিকে খাবারের কক্ষের দিকে এগিয়ে আসেন গোলানি সদস্যরা। সেখানে বেশির ভাগ বন্দুকধারী লুকিয়ে ছিলেন। 

 

নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বলেছিল, ওই দিন নাহাল ওজ ঘাঁটিতে প্রতি ২৫ জন কমব্যাট সেনার বিপরীতে ১৫০ বন্দুকধারী প্রবেশ করেছিলেন।

 

জেনারেল জিভ বলেন, সীমান্তবেড়ার ৭০টির বেশি জায়গা ভেঙে তিন হাজার সন্ত্রাসী ঢুকে পড়েছিল। তারা জানত, তাদের বেশি দক্ষতা নেই, তাই তারা সংখ্যায় জোর দিয়েছিল।

 

সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটের দিকে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর হেলিকপ্টার থেকে বন্দুকধারীদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ শুরু হয়।

 

বেলা ১১টার দিকে শ্যারন যুদ্ধ কক্ষে ঢুকে পড়েন হামাস সৈন্যরা। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় দরজার তালা খুলে যায়। দরজা খোলা থাকায় হামাস যোদ্ধারা গুলির সঙ্গে গ্রেনেড ছুড়তে থাকেন। গোলানি সৈন্যদের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে একজন নিহত হন। জেনারেল জিভ বলেছিলেন, সৈন্যরা নিজেদের সুরক্ষার জন্য দরজার তালাগুলোর উপর নির্ভর করে, যা ইতিমধ্যেই ব্যর্থ হয়েছে।

 

দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে শ্যারনসহ সাতজন যুদ্ধকক্ষ থেকে টয়লেটের জানালা বেয়ে বের হওয়ার পথ খুঁজে পান। ঘাঁটির ওই পালায় দায়িত্বরত তাৎজপিতানিয়ত সদস্যদের মধ্যে শুধু শ্যারন বেঁচে ছিলেন। অন্যরা হয় নিহত হয়েছেন বা তাদের ধরে নিয়ে যায় হামাসের বন্দুকধারীরা। 

 

ওই দিন ইসরায়েলে ৩০০ সেনাসহ প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হন। ২৫১ জনকে গাজায় নিয়ে বন্দী করা হয়। ওই দিন থেকেই গাজায় নির্বিচার হামলা শুরু করে ইসরায়েল। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত ৪১ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।

 

সূত্র: বিবিসি