ঢাকা শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৬ই চৈত্র ১৪৩০

বড় বোনের সিঁড়ি ছিল মুনিয়া ?


৩০ এপ্রিল ২০২১ ১৭:৫৩

সংগৃহিত

রাজধানীর গুলশানের একটি ফ্ল্যাট থেকে তরুণী মোসারাত জাহান মুনিয়ার মরদেহ উদ্ধারের পর ঘটনা নানা ডালপালা মেলছে। আত্মহত্যায় মারা যাওয়া ওই তরুণীর জীবনযাত্রা নিয়েও উঠছে প্রশ্ন। কলেজপড়ুয়া ছাত্রী থাকতেন লাখ টাকার বাসায়। ভাড়া আসতো কোথা থেকে? জীবনযাপন, পড়াশোনার খরচই বা দিতো কে?

বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর বড়বোন নুসরাত জাহানই ছিলেন তার অভিভাবক। গণমাধ্যমে দেয়া বক্তব্য থেকে জানা যায়, নুসরাত বোনের সব বিষয়েই জানতেন তিনি। প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কি তিনি জেনে শুনেই ছোটবোনকে এভাবে সমর্থন দিয়েছেন? বোনের দেখভালের যে দায়িত্ব তার ওপর ছিল তার কী তিনি পালন করেছেন? বোনকে কি উপরে ওঠার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করছিলেন তিনি?

এসব প্রশ্নের জবাব জানতে বৃহ্স্পতিবার নুসরাত জাহানের মুঠোফোনে একাধিকবার চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে বুধবার একটি ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে নুসরাত জাহান বলেন, ‘আমি মুনিয়াকে বিভিন্ন সময় বোঝানোর চেষ্টা করেছি। সে বোঝেনি। এনিয়ে আমার সঙ্গে তার বিভিন্ন সময় বাকবিতণ্ডা হয়েছে। মনোমালিন্য হয়েছে। আমি তাকে বোঝাতে পারিনি।’

মুনিয়ার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা শহরের উজির পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে। তার বাবা ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মারা যান। তার বছর তিন পর ২০১৮ সালের এপ্রিলে মাও অসুস্থ হন। মারা যান জুন মাসে। বাবা ছিলেন বীরমুক্তিযোদ্ধা। মা ছিলেন ব্যাংকার। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর তার অভিভাবক হিসেবে বোন নুসরাতই ছিলেন। তাদের একমাত্র ভাই আশিকুর রহমান সবুজের সঙ্গে সম্পদের উত্তরাধিকার নিয়ে সম্পর্কের টানাপোড়েন ছিল। এজন্য একবার মামলাতেও নাকি যেতে হয়েছে দুই বোনকে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মুনিয়ার পরিবার গ্রামে একটি বাড়ি ছাড়া তেমন কোনো সম্পদ নেই। বোন নুসরাতের স্বামী একজন ব্যাংকার। মুনিয়ার পড়াশোনার খরচ একটা সময় বোন ও স্বামীই চালাতেন। তখন মুনিয়া কুমিল্লাতে থেকেই পড়াশোনা করত। পরে তিনি যখন ঢাকায় চলে আসেন তখন উচ্চাভিলাষী জীবনযাত্রার কারণে পরিবারের সঙ্গেও তার দূরত্ব ‍সৃষ্টি হয়। তার অনেক সিদ্ধান্তের ব্যাপারে বোন-ভাই খুশি ছিলেন না।

এদিকে মুনিয়ার বোন গণমাধ্যম এবং মামলার এজহারে যে তথ্য দিয়েছেন তাতে স্পষ্ট যে মুনিয়া ঢাকার গুলশানে কোথায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন তা তারা আগে থেকেই জানতেন। এই বাসা ভাড়াসহ তার জীবনযাপনের অর্থ কোথা থেকে আসছে সেটিও তারা জানতে। কিন্তু তারপরও তারা কেন বোনের বিপথগামিতার বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেননি, সেটিই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

স্থানীয় সূত্রসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত বিভিন্ন তথ্যে জানা যায়, স্কুলজীবন থেকেই উচ্চাভিলাষী জীবনের প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল মুনিয়ার। অভিযোগ পাওয়া যায়, কুমিল্লাতে থাকতেই একজন বিবাহিত পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়েছিলেন মুনিয়া। পরে ওই ছেলের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় বোন নুসরাত মামলাও করেছিলেন। পরে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় এসেও অভিনয় জগতের চাকচিক্যময় জীবনের প্রতিও নাকি আগ্রহ ছিল মুনিয়ার। এই জগতেও দু-একজনের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যা নিয়েও বিভিন্ন সময় মানসিক যন্ত্রণা পোহাতে হয়েছে ‍মুনিয়া ও তার পরিবারকে।

মধ্যবিত্ত পরিবারের কলেজপড়ুয়া মেয়ে হলেও মুনিয়ার চলাফেরা, জীবনযাত্রা, পেশাকপরিচ্ছদেও ছিল উচ্চবিত্তের ছাপ। তার ঘনিষ্ঠজন ও সহপাঠীদের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, মুনিয়া তাদের সহপাঠী হলেও তাদের সঙ্গে তার জীবনযাত্রায় ছিল অনেক তফাত। এসব কারণে পড়াশোনাতেও অনিয়মিত ছিলেন মুনিয়া। তার বোন নুসরাত জাহান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ঢাকায় আসার আগে মুনিয়া কথা দিয়েছিল ও এইচএসসির ফরমফিলাপ করবে। পরীক্ষা দেবে। আমি তার কথায় বিশ্বাস করেছিলাম। ‘

জীবনযাত্রায় উচ্চাশা ও কার্যত নিয়ন্ত্রণহীন জীবনে মুনিয়ার জড়িয়ে যাওয়ার পেছনে পরিবারের দায়িত্বহীনতাকে বড় করে দেখছেন মনোবিদরা। তারা মনে করেন, মুনিয়ার বয়সের একজন মেয়ের ভালো-মন্দ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা ততটা থাকে না। এক্ষেত্রে তাদের পরিবারের দিকনির্দেশনা ও যথাযথ পরামর্শ প্রয়োজন। মুনিয়া তা থেকে বঞ্চিত ছিল।

সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, ‘বাবা-মা হারা মুনিয়ার বড় বোন ছিলেন অভিভাবক। কিন্তু তিনি প্রকৃত অভিভাবকের মতো দায়িত্ব পালন করতে পেরেছেন কি না, এনিয়ে প্রশ্ন আসলে থেকেই যাচ্ছে। তবে মুনিয়ার বয়সী তরুণ-তরুণীরা অনেক সময় না বুঝে বিপথে পা বাড়ায়। এজন্য পরিবার-সমাজও দায়িত্ব এড়াতে পারে না।’