ঢাকা শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৮ই বৈশাখ ১৪৩১

গোল্ডেন মনির ইস্যুতে ফেঁসে যাচ্ছেন মন্ত্রি, এমপি সচিবসহ ৪২ ব্যক্তি


২ ডিসেম্বর ২০২০ ১৭:৫০

ফাইল ছবি

গোল্ডেন মনির চক্রের সংশ্লিষ্টতায় রাজউকের সাবেক ও বর্তমান চেয়ারম্যানসহ বেশকজন কর্মকর্তা, সাবেক প্রতিমন্ত্রী, সাবেক ও বর্তমান সংসদ সদস্য এবং কাউন্সিলরসহ ফেঁসে যাচ্ছেন ৪২ ব্যক্তি। বাংলাদেশ কাস্টমস, ভূমি এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের বর্তমান-সাবেক কিছু কর্মকর্তাও রয়েছেন এ তালিকায়। অনুসন্ধানে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) কেন্দ্রে রেখে এর সহযোগী হিসেবে মাঠপর্যায়ে কাজ করছে এনবিআরসহ সরকারি আরো দুটি গোয়েন্দা সংস্থা। এ সংস্থাগুলোই এই ৪২ ব্যক্তিকে গোল্ডেন মনিরচক্রের সংশ্লিষ্টতায় চিহ্নিত করেছে।

দুদকের সূত্র জানায়, মনিরের বিরুদ্ধে দুদকের দায়ের করা পুরোনো মামলার সূত্র ধরেই এগিয়ে যাচ্ছে অনুসন্ধান টিমগুলো। বিশেষ করে ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর রমনা থানায় মনিরের বিরুদ্ধে একটি মামলা করে দুদক। দুদকের সাবেক উপপরিচালক হারুনুর রশিদের দায়ের করা ওই মামলায় মনিরের বিরুদ্ধে এক কোটি ৬১ লাখ টাকা অবৈধ সম্পদের অভিযোগে মামলা করেছিল। সেই মামলার এখনো তদন্ত চলছে। সম্প্রতি ৬১০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রতিবেদন কমিশনে জমা দিয়েছেন ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক সামছুল আলম।

২০১২ সালের মামলা সূত্রে জানা গেছে, নব্বইয়ের দশকে ঘনিষ্ঠ কয়েকজন মনিরকে ১ কোটি ৬১ লাখ টাকা দান করেন। এ টাকা দিয়েই তিনি ব্যবসা করে সকল সম্পদ অর্জন করেছেন। তবে দানকারী ওই ব্যক্তিদের কোনো পরিচয় বা তাদের দুদকের কাছে হাজির করতে পারেনি মনির।

দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, রাজউক ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে প্লট বাণিজ্য করেছেন মনির। এ ছাড়া কাস্টমস, বিআরটিএ’র কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে স্বর্ণ চোরাচালান ও শুল্ক ফাঁকি দিয়ে গাড়ি আমদানি করেছেন মনির হোসেন। রাজউক ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে ২০০৪ সাল থেকে মনির অবৈধ পন্থায় রাজউকের প্লট দখল শুরু করেন। ২০০৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত তিনি রাজউকের বাড্ডা প্রকল্প থেকেই দেড়শ প্লট বাগিয়ে নেন। ওই প্রকল্পে জমির ক্ষতিগ্রস্ত মালিক হিসেবে যাদের প্লট পাওয়ার কথা সেই প্লটগুলো নানা কৌশলে বাগিয়ে নেয় মনিরচক্র। এ কাজে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে সাবেক একজন গণপূর্তমন্ত্রী, সাবেক কাউন্সিলর এম এ কাইউম, রাজউকের সাবেক ক’জন চেয়ারম্যান ও সদস্য।

গত ২১ নভেম্বর গ্রেপ্তারের পর নতুন করে আলোচনায় আসে মনির হোসেন। তার বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের পৃষ্ঠপোষকদের খুঁজতে এবার সমন্বিতভাবে মাঠে নেমে পড়েছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। সূত্র জানায়, এরই মধ্যে গণপূর্ত ও রাজউকের বর্তমান ও সাবেক ২৩ কর্মকর্তা, কাস্টমসের ৬ কর্মকর্তা এবং সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যসহ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ১৩ জনের একটি তালিকা তৈরি হয়েছে। অনুসন্ধানে এ তালিকা শতাধিক ছাড়িয়ে যেতে পারে বলেও সংশ্লিষ্টরা জানান।

সূত্রমতে তালিকায় যারা রয়েছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান জি এম জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়া ও আব্দুর রহমানসহ আরো দুজন সাবেক চেয়ারম্যান, বর্তমান চেয়াম্যান সাঈদ নূর আলম, পূর্বাচল প্রকল্পের পরিচালক শেখ শাহিন। এ ছাড়া রাজউকের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন- মাহমুদুল হক, ওদুদ, ইফতেখার, আলম, আমজাদ, আবদুল হাই, মনির হোসেন, আখতারুজ্জামান, হারুনুর রশিদ, মোহাম্মদ রফিক, তরিকুল ইসলাম, সহকারী পরিচালক সামসুল হক মিলক্কী প্রমুখ। সাবেক সহকারী পরিচালক আবু মুসা সম্প্রতি মারা যাওয়ায় মনিরের সহযোগী তালিকা থেকে তাকে বাদ দেওয়া হয়। রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের মধ্যে সাবেক একজন গণপূর্তমন্ত্রী, ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর এম এ কাইউম, ডিএনসিসির ৪৪ নং ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর মো. শফিকুল এবং সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক রিয়াজ উদ্দিনসহ আরো কয়েকজন।

দুদক সচিব মুহাম্মদ দিলওয়ার বখত বলেছেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ (এনবিআর) সরকারি কয়েকটি সংস্থার সহযোগিতায় মনিরচক্রের অনুসন্ধনে কাজ করছে শক্তিশালী টিম। অপরাধ শিডিউলভুক্ত হলে গোল্ডেন মনিরচক্রের বিরুদ্ধ মামলা করবে দুদক।

মনিরচক্রের অনুসন্ধানে থাকা একজন কর্মকর্তা বলেন, তার যেসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে সেগুলো সাইনবোর্ড মাত্র। এগুলোর আড়ালে তার মূল কাজ অবৈধ ব্যবসা। এই কাজে যখন যে দল ক্ষমতায় সেই দলের যেসব মন্ত্রী-এমপিকে প্রয়োজন তাদের কাজে লাগিয়েছে শেয়ার বা অর্থের বিনিময়ে। রাজউক-এর গণপূর্ত তার এই সময়ের বিচরণ ক্ষেত্র। এখানে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে তার নিজস্ব সিন্ডিকেট আছে। সোনা চোরাচালানের অবৈধ অর্থ সে রাজউকের কাজে লাগিয়ে অবৈধ সম্পদ বাড়িয়েছে।

উল্লেখ্য, রাতভর অভিযানের পর গত ২১ নভেম্বর সকালে রাজধানীর মেরুল বাড্ডা এলাকায় ডিআইটি প্রজেক্টের ১৩ নং রোডের নিজ বাসা থেকে র্যাবের হাতে আটক হন মনির হোসেন। অভিযানের সময়ে মনিরের বাড়ি থেকে নগদ ১ কোটি ৯ লাখ টাকা, চার লিটার মদ, আট কেজি স্বর্ণ, একটি বিদেশি পিস্তল ও গুলি উদ্ধার করে। এরপর র্যাব বাদী হয়ে ডিএমপি’র বাড্ডা থানায় ৩টি মামলা দায়ের করে।