ঢাকা শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৮ই বৈশাখ ১৪৩১

ফাঁস হচ্ছে পাপিয়ার কেএমসি বাহিনীর নানা অপকর্ম


৭ মার্চ ২০২০ ১৮:৫৪

তাদের সবার হাতেই ইংরেজিতে লেখা ট্যাটু 'কেএমসি'। নরসিংদীর লোকজনও চেনে কেএমসি বাহিনী হিসেবেই। গ্রুপের সদস্যরা মোটরসাইকেলে দাপিয়ে বেড়াত শহরের অলিগলি। সবাই তাদের জানতেন যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক শামিমা নূর পাপিয়ার বাহিনী হিসেবে। তাই মুখ বুঝে সবাই সবকিছু সহ্য করতেন। এই বাহিনীকে যাদের দমনের কথা ছিল, সেই স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও ছিল নিশ্চুপ। ফলে নরসিংদী শহরে কেএমসি বাহিনীর আচরণ ছিল 'যম'-এর মতো। অবশ্য সেই পাপিয়া র‌্যাবের হাতে ধরা পড়ার পর বেরিয়ে আসছে তার বাহিনীর নানা অপকর্মের কাহিনি। মুখ খুলতে শুরু করেছেন লোকজনও। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও নরসিংদীর লোকজন বলছেন, গ্রেপ্তারের পর বহিষ্কার হওয়া পাপিয়ার এই কেএমসি বাহিনীর মূল কাজ ছিল চাঁদাবাজি আর মাদক ব্যবসা। মানুষকে জিম্মি করে, ফাঁদে ফেলে এরা পাপিয়ার হয়ে তাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করত। ইয়াবা পৌঁছে দিত নরসিংদী থেকে ঢাকা পর্যন্ত।

স্থানীয় লোকজন বলছেন, পাপিয়া ও তার স্বামী মফিজুর রহমান ওরফে মতি সুমন ২০১৯ সালের মাঝামাঝি এই কেএমসি বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। গ্রুপের ৩০ থেকে ৩৫ সদস্যের প্রায় সবাই ছিল বেতনভুক। পাপিয়া দম্পতি ধরা পড়ার পর এরা গা ঢাকা দিয়েছে। নরসিংদী শহরে এরই মধ্যে চাউর হয়েছে- ওই বাহিনীর অন্তত দুই সদস্য এরই মধ্যে দেশ ছেড়েছে। তারা তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী ছিল।

পাপিয়াকে গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নেওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানতে পেরেছে, কেএমসি নামে শরীরে উল্কি (ট্যাটু) আঁকার রহস্যও। তারা দাবি করে, খাজা বাবার ভক্ত হিসেবেই শরীরে এই উল্কি এঁকেছিল তারা। পাপিয়া গ্রেপ্তারের পর বলেছেন, কেএমসির কে-তে 'খাজা', এম-এ 'মঈনুদ্দীন' আর সি-তে 'চিশতী' বোঝাতেই তার অনুসারীরা শরীরে এই ট্যাটু এঁকেছিল।

গত ২২ ফেব্রুয়ারি দেশ থেকে পালানোর সময় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে পাপিয়া ও তার স্বামী সুমনসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। এরপর ঢাকার বিভিন্ন থানায় তাদের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা হয়। এসব মামলায় ১৫ দিনের রিমান্ডে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হেফাজতে রয়েছেন পাপিয়া।

পাপিয়াকে গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে সংশ্নিষ্ট র‌্যাবের সূত্র বলছে, পাপিয়া ও তার স্বামী সুমনের হাতেও কেএমসি বাহিনীর সেই ট্যাটু রয়েছে। এর বাইরে পাপিয়ার ডান হাতে একটি ধর্মীয় স্থাপনার ছবি থাকলেও বাঁ হাতে এক দেবীর ট্যাটুও রয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, কেএমসি বাহিনীর সবাই মাদকাসক্ত। এরা পাপিয়ার হয়ে ইয়াবার চালান বহন করত। নিজেরাও সেই ইয়াবা বিক্রি করে টাকা দিত পাপিয়ার তহবিলে। শুধু তাই নয়, পাপিয়া তার এই বাহিনীর সদস্যদের দিয়েই নিজের একাধিক দামি গাড়িতে ইয়াবার চালান বহন করাতেন। কক্সবাজারে একাধিক ইয়াবা সম্রাটের সঙ্গে এই গ্রুপের সখ্য থাকার তথ্য মিলেছে। ইয়াবার চালান বহনের পাশাপাশি পাপিয়া নিজেও ইয়াবার আসর বসাতেন। গুলশানের পাঁচতারকা হোটেল ছাড়াও ঢাকার আরও অন্তত পাঁচটি তারকা মানের হোটেল, ফার্মগেটে নিজের ফ্ল্যাট ও পরিচিতদের একাধিক ফ্ল্যাটে রঙ্গশালা গড়ে তুলেছিলেন পাপিয়া। এসব আসরে ইয়াবা ও মদের সঙ্গে নানা ধরনের অপকর্ম চলত।

নরসিংদীর স্থানীয় লোকজন বলছেন, কেএমসি বাহিনীর সদস্যরা পাপিয়ার 'রাজ্যে' সব সময় তৎপর থাকলেও ওই দম্পতি নরসিংদী শহরে গেলে বাহিনীর সদস্যদের তৎপরতা আরও বেড়ে যেত। পাপিয়া-সুমন এলাকায় গেলে এরা মোটরসাইকেল নিয়ে তাদের গাড়িবহরের আগে-পিছে মহড়া দিত। পাপিয়ার নির্দেশে নানা কারণে লোকজনকে ধরে টর্চার সেলে নিত এরা। এরপর অনেকের সঙ্গে রূঢ় আচরণ করা হতো। দাবি করা চাঁদার টাকা না দিলে পাপিয়া বাহিনীর নারী সদস্যদের সঙ্গে আপত্তিকর ছবি তুলে রাখা হতো। পরে সেই ছবি দিয়ে জিম্মি করে আরও বড় চাঁদাবাজি করা হতো।
পুলিশের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পাপিয়াকে গ্রেপ্তারের পর অন্তত পাঁচজন ভুক্তভোগী ব্যক্তি থানায় গিয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছেন, তারা পাপিয়ার কেএমসি বাহিনীর হাতে জিম্মি রয়েছেন। চাঁদা না দেওয়ায় জোর করে তাদের আপত্তিকর ছবি তুলে রেখেছিলেন পাপিয়া তার লোকজনকে দিয়ে।

পাপিয়া রিমান্ডে নতুন কোনো তথ্য দিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কোনো কর্মকর্তা আনুষ্ঠানিকভাবে মুখ খোলেননি। তারা বলেছেন, ওই ঘটনায় দায়ের মামলার তদন্ত চলছে এবং তথ্য পেতে আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রয়েছে।

এদিকে পুলিশের অন্য একটি সূত্র জানিয়েছে, পাপিয়ার ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলোর বিষয়ে ছায়াতদন্ত শুরু করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি। শিগগিরই পাপিয়া ও তার স্বামীর বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে আরও মামলার প্রস্তুতি চলছে।