ঢাকা রবিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৫, ৮ই বৈশাখ ১৪৩২


লাশ দাফনের ১১ দিন পরও জীবিত তরুণী, কি সে রহস্য?


১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:৩৯

যশোরের চৌগাছার সাথী খাতুনের কথিত ‘লাশ উদ্ধারের’ ১১ দিন পর তাকে জীবিত উদ্ধার করেছে পুলিশ। পরকীয়া প্রেমের সূত্র ধরে স্বামীর ঘর ছেড়েছিল সে। রোববার (৯ সেপ্টেম্বর) ভোরের দিকে প্রেমিকের ধর্মপিতা সদর উপজেলার ইছালি এলাকার জলকর গ্রামের আজিজ লস্করের বাড়ি থেকে সাথী খাতুনকে উদ্ধার করা হয়েছে।

সাথী খাতুন চৌগাছার নয়ড়া গ্রামের আমজেদ আলীর মেয়ে এবং একই উপজেলার চাঁদপাড়া গ্রামের গোলাম মোস্তফার স্ত্রী। তাদের এহসান নামে ছয় বছরের একটি পুত্র সন্তান রয়েছে। গত ১৪ জুলাই স্বামীর বন্ধু, একই গ্রামের মান্নুর সঙ্গে তিনি পালিয়ে যান। এরপর তারা যশোর সদর উপজেলার জলকর গ্রামে অবস্থান করছিলেন। কয়েক দিন আগে মান্নু মালয়েশিয়া চলে যান। কিন্তু সাথী আর নিজের বাড়িতে ফিরে যাননি।

সাথীর ভাই বিপ্লব হোসেন জানান, সাথী গত ১৪ জুলাই ‘বাইরে কাজে যাচ্ছি, বিকেলে ফিরে আসবো’ বলে বাড়ি থেকে বের হয়। এরপর থেকে তার কোনো সন্ধান ছিল না।

এ ঘটনায় তার বাবা আমজাদ আলী বাদী হয়ে চৌগাছা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও করেছিলেন। এদিকে, ২৯ আগস্ট রাতে যশোরে সরকারি সিটি কলেজ এলাকা থেকে পলিথিন মোড়ানো অজ্ঞাত পরিচয় এক তরুণীর গলাকাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এই লাশ উদ্ধারের খবরে পরদিন ৩০ আগস্ট যশোর কোতোয়ালি থানায় ছুটে যান চৌগাছার নয়ড়া গ্রামের আমজেদ আলী। তিনি ‘অজ্ঞাতপরিচয় লাশটি’ তার মেয়ে সাথী খাতুনের বলে শনাক্ত করেন।

বিপ্লব হোসেন দাবি করেন, তার বাবা লাশ দেখে হত-বিহ্বল হয়ে তাৎক্ষণিক লাশটি তার মেয়ের বলে শনাক্ত করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে এ নিয়ে তদন্ত হলে তিনি জানতে পারেন তার ভুল হয়েছে।

এদিকে, সাথীর বাবা লাশ শনাক্ত করায় পুলিশ সাথী হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে মাঠে নামে।

উদ্ধার হওয়া সাথী খাতুন বলেন, ‘স্বামী নির্যাতন করতো। তাই নির্যাতন থেকে রেহাই পেতে ১৪ জুলাই স্বামীর বাড়ি ছেড়ে যশোরে চলে আসি। শহরের নিউ মার্কেটে বাসে নেমে এক ঘন্টা বসেছিলাম। এক পর্যায়ে মালয়েশিয়া প্রবাসী প্রতিবেশি মান্নুকে ফোন দিই। তিনি ধৈর্য্য ধরতে বলেন। যেন আত্মহত্যা না করি, সেই পরামর্শ দেন। এক পর্যায়ে সদরের ফতেপুর ইউনিয়নের জলকর গ্রামে যাই। যাওয়ার পথে ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি ভেঙে পানিতে ফেলে দিই। এরপর ওই গ্রামের আজিজ লস্করের বাড়িতে আশ্রয় নিই। ৭ সেপ্টেম্বর আজিজ লস্কর পত্রিকার পাতায় আমার মৃত্যুর সংবাদ দেখেন। তারপর থেকে তিনি আমাকে আর আশ্রয় দিতে রাজি হননি। এরপর ৮ সেপ্টেম্বর বাড়িতে আব্বার মোবাইল নম্বরে (মুখস্থ ছিল) কল করি। পুলিশকেও বিষয়টা জানাই। পুলিশ আজ উদ্ধার করেছে।’

পুলিশের ভিন্ন কথা

যদিও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক (এসআই) আমিরুজ্জামান বলছেন ভিন্ন কথা। মামলার তদন্ত করতে গিয়ে তিনি খুঁজে পান চাঞ্চল্যকর এক তথ্য। এই প্রতিবেদকের কাছে তুলে ধরেন ঘটনা প্রবাহ।

এসআই আমিরুজ্জামান বলেন, ‘মেয়েটির সঙ্গে মোবাইল ফোনে বিভিন্ন সময়ে একাধিক ছেলের সম্পর্ক ছিল। তদন্ত করতে গিয়ে পরিবারের লোকজন জানালো গত ১৬ মার্চ সাথী খাতুন ভারতে গিয়েছিল চিকিৎসার জন্য। এক মাস ১১ দিন পর চিকিৎসা শেষে দেশে ফেরে। তবে সাথী একাই গিয়েছিল ভারতে বিষয়টি আমার সন্দেহ হয়। এরপর সাথীর পাসপোর্ট বইটি যাচাই করি। এতে দেখা যায় সাথী ১৬-২৪ মার্চ ভারতে ছিল। কিন্তু পরিবারের লোকজন বলছে ১ মাস ১১ দিন। তাহলে বাকী দিন কোথায় ছিল?’

‘ভারতে থাকাকালীন সাথী ভারতের একজনের মোবাইল নম্বর থেকে কথা বলেছিল। সেই নম্বর জোগাড় করি। কথা বলে জানতে পারি, সাথী ভারতে প্রবেশ করার এক ঘন্টা আগে মালেশিয়া প্রবাসী চাঁদপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মান্নু ওপারে (ভারতে) হাজির হয়। সেখান থেকে তারা দুজন ভারতে চিকিৎসার জন্য যায়। পরে চিকিৎসা শেষে ২৪ মার্চ সাথী ও মান্নু দেশে আসে।’

‘মান্নু মালয়েশিয়া থেকে ভারত হয়ে বাংলাদেশে ঢুকলেও পরিবারের কেউ জানতো না। ২৪ মার্চ থেকে এক মাসের বেশি সময় সাথী ও মান্নু যশোর সদর উপজেলার জলকর গ্রামের আজিজ লস্করের বাড়িতে অবস্থান করেন।’

কে এই আজিজ লস্কর

এসআই আমিরুজ্জামান বলেন, ‘মান্নুর সাথে আজিজ লস্করের পরিবারের পরিচয় ২০১২ সালে। মালেশিয়া থেকে রং নাম্বারে আজিজ লস্করের পরিবারের সঙ্গে মান্নুর পরিচয় হয়। আর আজিজ দম্পতির কোনো সন্তান না থাকায় মান্নু তাদের ধর্ম পিতা-মাতা বলেন। সেই থেকে তাদের সম্পর্ক।’

‘এপ্রিল মাসের শেষের দিকে মান্নু মালয়েশিয়া ফিরে যান। আর সাথী বাড়িতে। বাড়ির সবাই জানে সাথী চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরেছে।’

‘সর্বশেষ গত ১৪ জুলাই সাথী স্বামীর বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে যান। এরপর সদর উপজেলার জলকর গ্রামে পূর্ব পরিচিত আজিজ লস্করের বাড়িতে আশ্রয় নেন। রোববার সকালে সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়েছে।’

লাশটি কার?

তাহলে যে লাশ দাফন করা হয়েছে, সেটি কার? এমন প্রশ্নের জবাবে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আমিরুজ্জামান বলেন, ‘ধরে নিয়েছিলাম ওই লাশটি সাথীর। কিন্তু তদন্ত করতে গিয়ে আসল রহস্য উন্মোচন হয়েছে। এবার ওই লাশটি আসলে কার, সেই রহস্য উদঘাটনে কাজ করবো।’

যশোর কোতোয়ালি থানার অফিসার ইনচার্জ অপূর্ব হাসান জানান, আট বছর আগে চৌগাছা উপজেলার নায়ড়া গ্রামের সাথী খাতুনের সঙ্গে চাঁদপাড়া গ্রামের গোলাম মোস্তফার বিয়ে হয়। তাঁদের ছয় বছরের একটি পুত্রসন্তান রয়েছে। সাথীকে উদ্ধারের পর গতকাল বিকেলেই তাকে আদালতে তোলা হয়। সেখানে সাথী প্রকৃত ঘটনা খুলে বলেন এবং ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি প্রদান করেন।

এদিকে গত ২৯শে আগস্ট যশোর সরকারী সিটি কলেজের পুকুর থেকে পলিথিনে মোড়ানো গলাকাটা এক তরুণীর লাশকে সাথী হিসেবে চিহ্নিত করে তার স্বজনরা নিজ গ্রামে কবরস্থ করেন। গতকাল সাথীকে জীবিত উদ্ধারের পর কবরস্থ ওই তরুণীর পরিচয় নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে রহস্যের।

কেআই