ঢাকা মঙ্গলবার, ১৮ই মার্চ ২০২৫, ৫ই চৈত্র ১৪৩১


তেঁতুলিয়ায় কৃষি অফিসারের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ,থেমে নেই তার সহকর্মীরা


১৮ মার্চ ২০২৫ ০৩:০২

পঞ্চগড় প্রতিনিধি:

পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলায় নির্ধারিত প্রকল্পের ধান বীজ বিতরন অনুষ্ঠানে কৌশলে ভিন্ন প্রকল্পের তালিকায় নাম থাকা কৃষকদের মাঝে বীজ বিতরনের সময় হাতেনাতে ধরা পড়ার ২ মাস হওয়ার পরও উপজেলা কৃষি অফিসার তামান্না ফেরদৌস সহ কৃষি অফিসের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নেয়া হয়নি কোন ব্যবস্থা৷ 


গত ২ জানুয়ারি জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলা কৃষি অফিস কার্যালয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের রবি মৌসুমে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের মাঝে কৃষি উপকরণ হিসেবে ধান বীজ বিতরনে অনিয়মের সময় হাতেনাতে ধরা পড়েন কৃষি অফিসারসহ তার অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা৷ 


জানা যায়, তেঁতুলিয়া উপজেলায় রবি মৌসুমে ২ কেজি করে বোরো (হাইব্রিড জাতের) ধানের বীজ ১ হাজার জন তালিকাভুক্ত কৃষকদের মাঝে বিতরনের জন্য জেলা কৃষি পুনর্বাসন বাস্তবায়ন কমিটির গত বছরের ৩১ অক্টোবর সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ প্রনোদনা কর্মসূচী বাস্তবায়নের নীতিমালা অনুযায়ী একজন কৃষক ১ বিঘা জমির জন্য ২ কেজি বরো ধানের বীজ সহায়তা পাবেন। কিন্তু, কৃষি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মোতাবেক অনুমোদিত ও প্রকাশিত কৃষকদের তালিকা অনুযায়ী বীজ বিতরনের পরিবর্তে প্রতি ৫ জন কৃষকের জন্য একটি করে নামবিহীন টোকেন প্রস্তুত করে বীজ বিতরন করা হচ্ছে এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে সেদিন  কৃষি সম্প্রসারণ অফিস চত্ত্বরে গিয়ে ঘটনার সত্যতা পান সদ্য বিদায়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফজলে রাব্বিসহ গনমাধ্যম কর্মীরা৷ 


সেদিন বিতরনের এক পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার, উপজেলা নির্বাচন অফিসার, মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তাসহ কয়েকজন এ বিতরন কার্যক্রম পরিদর্শনের লক্ষ্যে কৃষি অফিসারের কার্যালয়ে যান। পরে উপকারভোগী তালিকাভুক্ত কৃষকসহ সকল কর্মকর্তা মিলে বিতরণের ছবি তুলতে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন কৃষককে ধানবীজ সহ দাড় করিয়ে দেয়া হয়েছে। এসময় তালিকা অনুযায়ী কৃষককদের নাম মেলাতে গিয়ে দেখা যায়, ধানবীজ সহ উপস্থিত অনেক কৃষকদের নাম তালিকায় নেই। উপস্থিত সাংবাদিকদের প্রশ্নের প্রেক্ষিতে, উপজেলা নির্বাহী অফিসার সহ অন্যান্য কর্মকর্তারা কৃষকদের হাতে থাকা টোকেন যাচাই করে দেখতে পান, একই অর্থ বছরের আরেক প্রকল্প (রাজস্ব ফলোআপ বা প্রর্দশনী) এর তালিকা প্রাপ্ত কৃষককে এ ধান বীজ দেয়া হয়েছে। তিনি ব্যাখ্যা জানতে চাইলে উপজেলা কৃষি অফিস সংশ্লিষ্ট সকলে তা স্বীকার করেন এবং ফটোসেশনের জন্য অন্য প্রকল্পের কৃষককে ডেমো হিসেবে ব্যনারের সামনে দাড়িয়ে রাখা হয়েছে বলে স্বীকার করেন কৃষি অফিসারসহ তার দপ্তরের অন্যান্য সকলে।


ঘটনাস্থলের একটি ভিডিও এসেছে প্রতিবেদকের কাছে,ভিডিওতে দেখা যায়,২ কেজি করে ধান বীজ যাদের দেয়া হবে তাদের ৫ জনকে নিয়ে একটি টিম করেন কৃষি অফিস৷  প্রতি ৫ জনকে ১ টি টোকেন দেন বলে জানান তারা৷ অতিথিরা বিতরন করার সময় কৃষকদের হাতে ১ কেজি করে দুটি ধান বীজের প্যাকেট ধরিয়ে দেন এবং ফটোশেসন করলে বীজ পাওযা কৃষকদের উপস্থিতি জানতে চায় গনমাধ্যমকর্মীরা৷ এসময় সাথে সাথে টোকেন চেক করা হলে,আমিরুল নামে এক কৃষক ২ কেজি ধান সংগ্রহের জন্য ছবি তোলার জন্য দাড়ান এবং বীজ সংগ্রহ করেন। পরে তার হাতে থাকা টোকেন যাছাই করে দেখা যায় তার কাছে থাকা টোকেনটি  অন্য প্রকল্পের টোকেন৷  আর সেই প্রকল্পে  কৃষকদের ৫ কেজি ধান বীজ বিতরন করা হবে এটি কৃষি অফিস অতিথিদের অবগত করেননি, এমনকি জানানোও হয়নি৷ ফলে এক প্রকল্পের আড়ালে অন্য প্রকল্প বাস্তবতায়ের চেষ্টা করে কৃষি অফিস৷ 


এবিষয়ে  কৃষক আমিরুল ইসলাম ভোলা বলেন,এই টোকেন আমাকে বিপ্লব দিয়েছে। স্যার এই ধান আমার নয়। এই ধানে ওদের।  ৫ জন লোককে ধান দিবে তাই এখানে দাড়িয়ে দিয়েছে ছবি তোলার জন্য ৷ ৫ কেজি ধান দিবে তাই এসেছি৷ আমাকে দাড়াতে বললো  তাই দাড়িয়েছি৷ 


একটি টোকেন সংগ্রহ করা যেখানে লেখা রয়েছে, আনিছুর ৫ কেজি, চান মিয়া ৫ কেজি। অথচ খবর নিয়ে জানা যায়,ধান বীজ উত্তোলন করতে আসা ওই ব্যক্তির নাম আমিরুল হক ওরফে ভোলা। পেশায় তিনি কাঁচামাল বিক্রেতা ৷ তিনি তার ছেলের নামে ধান বীজ তুলতে আসেন৷ 


এছাড়া উপজেলার ৬ হাজার কৃষকদের মাঝে কৃষি প্রণোদনা বিতরনে  ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগও  উঠেছে উপজেলা কৃষি অফিসার তামান্না ফেরদৌস ও তার দপ্তরের কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। একাধিক বার মৌখিক ও তথ্য আইনে আবেদন করা হলেও এখন পর্যন্ত অনুমোদিত সুবিধাভোগী কৃষকদের তালিকা হস্তান্তর করেনি৷ 


স্থানীয় কৃষকরা অভিযোগ করেন, প্রকৃত কৃষকদের মাঝে সরকারের এই প্রণোদনা বিতরণ না করে নিজের পছন্দের মানুষদের সেগুলো বিতরণ করা হয়েছে। একই পরিবারের কয়েকজন সদস্যদের নামে তালিকা, একই ব্যক্তির নাম বারবার তালিকাভুক্ত করা এবং প্রনোদনার বীজ ও সার বিতরন না করে বিক্রির অভিযোগও পাওয়া গেছে। এছাড়া উপ-সহকারীরা তাদের নিজস্ব দোকান থাকায় তাদের নিজেদের পছন্দের লোকের তালিকা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে৷ এছাড়া  উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোতালেব হোসেন,রাজিবসহ কৃষি অফিসে চাকুরী করা ব্যক্তিদের নিজস্ব সার কীটনাশকের দোকান রয়েছে। 


এই বিষয়ে যোগাযোগ হলে সদ্য বিদায়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ ফজলে রাব্বি বলেন, সেদিনের ঘটনায় আমি অত্যন্ত বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে ছিলাম। উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাগণ কর্তৃক ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক নির্বাচন করে অগ্রাধিকারপূর্বক খসড়া তালিকা প্রস্তুত করার পরেও তা আবারো যাচাইয়ের অনুরোধ করে ছিলাম এবং সর্বশেষ সুধী সমাবেশ এর উদ্যোগ গ্রহন করা হয়েছিল। কিন্তু তারপরেও এ ধরনের বিশৃঙ্গখলা কোনভাবেই কাম্য নয়। 


এ বিষয়ে তেঁতুলিয়া উপজেলা কৃষি অফিসার তামান্না ফেরদৌস বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, শতভাগ প্রকৃত কৃষকদের তালিকা করে কৃষি প্রণোদনা বিতরণ করা হচ্ছে। এখানে কোন অনিয়মের ঘটনা ঘটেনি।


এদিকে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুল মতিন বলেন, এবিষয়ে আমার কাছে কোন অভিযোগ আসেনি৷ কোন ডকুমেন্টস থাকলে জানাবেন,খতিয়ে দেখা হবে৷ 


তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আফরোজ শাহীন খসরু জানান,এক প্রকল্পের আড়ালে আরেক প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়য় হাতেনাতে ধরা খাওয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই, বিষয়টি আমি আমার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করবো৷