ঢাকা সোমবার, ২১শে এপ্রিল ২০২৫, ৮ই বৈশাখ ১৪৩২


শিক্ষার্থীকে গুলি: রায়হান শরীফের বিরুদ্ধে বেড়িয়ে আসছে নানা অভিযোগ


৬ মার্চ ২০২৪ ১৫:১৬

সংগৃহীত

শিক্ষার্থীকে গুলি করে আলোচনায় আসা ডা. রায়হান শরীফের বিরুদ্ধে বেড়িয়ে আসছে নানা অজানা রহস্য। এ যেন কিছুতেই শেষ হচ্ছে না সিরাজগঞ্জ শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের শিক্ষক রায়হান শরীফের অভিযোগ।

শুধু শিক্ষার্থীদের ভয়ভীতি, ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করা, শ্রেণিকক্ষেই পিস্তল প্রদর্শনই না, চলার পথে যানবহন ও কর্মস্থলেও পিস্তল নিয়ে ঘুড়ে বেড়াতেন তিনি।

বুধবার (৬ মার্চ) খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের ক্যানটিনে বাকি খেতেন রায়হান শরিফ। টাকা চাইলে গুলি করার ভয় দেখাতেন তিনি। রাস্তায় চলার পথে ও বাসের একটি আসনের যাত্রীর দিকে পিস্তল তাক করে ভয় দেখান। তবে ছবিটি কবে ও কোথা থেকে তোলা হয়েছে সেটা জানা যায়নি। তবে এসব জেনেও নীরব ছিলেন কর্তৃপক্ষ।

এরআগে, সোমবার (৪ মার্চ) বিকেলে ক্লাস চলাকালীন সময়ে আরাফাত আমিন তমালকে (২২) নামের এক শিক্ষার্থীকে গুলি করেন শিক্ষক শরীফ। এই ঘটনার পর অবৈধ অস্ত্র রাখার অপরাধে পুলিশ বাদী হয়ে শিক্ষক শরীফের বিরুদ্ধে সদর থানায় একটি মামলা করে।

এ ছাড়া আহত শিক্ষার্থী আরাফাতের বাবা আব্দুল্লাহ আল আমিন আরেকটি মামলা করেন। এসব মামলায় শরীফকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। বর্তমানে তিনি জেল হাজতে রয়েছে।

শহরের বিএ কলেজ রোড এলাকায় নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক মুদি ব্যবসায়ী বলেন, শিক্ষক রায়হান শরীফ পিস্তল দিয়ে সবাইকে ভয় দেখাতেন। এটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু এর আগে কখনো কাউকে গুলি করেননি। এই প্রথম শুনলাম একজন শিক্ষার্থীকে তিনি ক্লাসে গুলি করেছেন। অস্ত্র কিনে নিজ বাড়িতে সংগ্রহ করে রাখাই যেন তার শখ হয়ে উঠেছিল।

সিরাজগঞ্জের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আশিক ইমরান বলেন, সম্প্রতি শহরের অভিসিনা হাসপাতালের সামনে শিক্ষক রায়হান শরীফ এক রিকশা চালককে পিস্তল দেখিয়ে ভয় দেখিয়েছেন। আমি ওই সময় ওখানেই দাঁড়ানো ছিলাম। ভেবেছিলাম তিনি প্রশাসনের লোক।

শহরের বেসরকারি নর্থ বেঙ্গল মেডিকেল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জহুরুল হক বলেন, রায়হান শরীফ ২০১৭ সালের দিকে নর্থ বেঙ্গল মেডিকেল কলেজে শিশু বিভাগে মেডিকেল অফিসার হিসেবে ৫ থেকে ৬ মাস কর্মরত ছিলেন। ওই সময়ও তিনি কলেজে অস্ত্রের ভীতি তৈরি করেছিলেন।

সবশেষ শিশু বিভাগের প্রধান ডা. লিয়াকত আলীকে পিস্তল ঠেকিয়ে ভয় দেখালে বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে আসে। পরে তাকে সেখান থেকে চাকরিচ্যুত করা হয়।

পিস্তল দিয়ে ভয় দেখানোর সত্যতা নিশ্চিত করে নর্থ বেঙ্গল মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের ডা. লিয়াকত আলী বলেন, হাসপাতালের একটি দায়িত্ব বণ্টনের বিষয় নিয়ে রায়হান শরীফ আমার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে ভয় দেখিয়েছিল। পরে বিষয়টি আমি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানাই। তখন ডাক্তারের বাবা সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ আব্দুর রাজ্জাককে ডেকে এনে বিষয়টি জানিয়ে রায়হানকে চাকরিচ্যুত করা হয়।

শিক্ষক শরীফ আদালতে স্বীকারোক্তিতে বলেছেন, তিনি ওই শিক্ষার্থীকে গুলি করেছেন। তবে ভয় দেখাতে পিস্তলটি বের করেছিলেন। কিন্তু অনিচ্ছাকৃত ভাবে গুলি বেড় হয়েছে।

গুলির ঘটনায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির সঙ্গেও কথা বলেছেন তিনি। তদন্ত কমিটির কাছে রায়হান শরিফ স্বীকার করেন, তাঁর কাছে দুটি আগ্নেয়াস্ত্র পিস্তল ছিল। সেই দুটির লাইসেন্স নেই। বিভিন্ন সময় আগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শনের বিষয়টি স্বীকার করেছেন তিনি।

ছাত্রীদের রাতে ফোন করে উত্ত্যক্ত করার বিষয়ে জানতে চাইলে শরীফ তদন্ত কমিটিকে বলেছেন, ছাত্রীদের পড়াশোনায় মনোযোগ বাড়াতে তিনি এটা করতেন।

রায়হান শরীফ সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবদুর রাজ্জাকের ছেলে। সিরাজগঞ্জে অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষকদের করা ‘প্রফেসরস গার্ডেন’ নামে ভবনে মা-বাবার সঙ্গে থাকেন শরীফ। তিনি পড়াশোনা করেছেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজে (রামেক)।

অনুসন্ধানে জানা যায়, তিনি রামেক ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ছিলেন। ইন্টার্নশিপ শেষ করে রাজশাহী থেকে সিরাজগঞ্জে এসে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে শিক্ষক হিসেবে চাকরি নিয়েছিলেন। তবে উগ্র আচরণের কারণে চাকরিচ্যুত হন। এক নারী চিকিৎসককে বিয়ে করেছিলেন শরীফ। সেই বিয়ে টেকেনি। পরে ২০২১ সালে বিসিএস (বিশেষ বিসিএস) দিয়ে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন।

গত সোমবার (৪ মার্চ) মনসুর আলী মেডিক্যালে গুলির ঘটনার পর জানা যায়, সার্বক্ষণিক রায়হানের সঙ্গী ছিলেন পিস্তল। রামেকে থাকাকালে শিক্ষার্থীদের মারধর এবং হরহামেশাই গভীর রাতে ক্যাম্পাসে গুলি ফোটাতেন শরীফ।

২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর রামেক হাসপাতালের একটি ওয়ার্ডে ইন্টার্ন চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন শরীফ। সেদিন ওই ওয়ার্ডে জয় নামের এক রোগী মারা যান। এর প্রতিবাদ করলে জয়ের স্বজনদের দিকে পিস্তল তাক করেন শরীফ।

এ ঘটনায় ১৩ নভেম্বর হাসপাতালে মহসিন আলী নামের এক রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ ওঠে বিনা চিকিৎসায়। ওই দিনও মহসিনের দুই ছেলেকে পিস্তল দেখিয়ে ভয় দেখান শরীফ।

সেই সময় মহসিনের স্ত্রী মানববন্ধনে বলেছিলেন, একজন ইন্টার্ন আমার ছেলেদের গুলি করে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। পরে গুলি না করে আমার ছেলেদের পিটিয়ে মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়। এই ঘটনার পর ১৫ নভেম্বর রামেক হাসপাতালে দুই রোগীকে মারধর করেছিলেন শরীফ।

ডা. রায়হান শরীফের সাবেক কর্মস্থল রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। ড. রায়হান এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আবাসিক মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২০২২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ১৬ মার্চ পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন।

এ প্রসঙ্গে রাজশাহী মহানগর ছাত্রলীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, রায়হান শরীফ ছাত্রজীবনেই একটা পিস্তল (অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র) কাছে রাখত। সেই সময়ে রামেক ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন কামাল হোসেন।

সাবেক ছাত্রলীগ নেতা কামাল হোসেন মুঠোফোনে জানান, শরীফ একটু রগচটা টাইপের মানুষ ছিলেন। পার্টি টাইমে মজা-মাস্তি করতেন। পরে বিসিএস দিয়ে তো স্বাভাবিক হয়েছিলো। হঠাৎ নিউজে দেখলাম, মেডিকেল কলেজের এক শিক্ষার্থীকে গুলি করার ঘটনা।

মনসুর আলী মেডিকেলের শিক্ষার্থীরা জানান, শিক্ষক শরীফ মাঝে মাঝে ছাত্রীনিবাসেও যেতেন। ছাত্রীদের মাদকদ্রব্য সেবনের আহ্বান জানাতেন। শ্রেণিকক্ষে পাঠদান এবং শিক্ষকদের সঙ্গে আড্ডার সময়ও অস্ত্র বের করে রাখতেন টেবিলের ওপর। গত ১০ মাসে কলেজ ক্যানটিনে প্রায় ১১ হাজার টাকা বাকি খেয়েছেন শরীফ। টাকা চাইলে ক্যানটিনের মালিক স্বপন ইসলামকেও গুলি করার ভয় দিখিয়েছেন।

স্বপন ইসলাম বলেন, টাকা চাইলে ডা. রায়হান শরিফ বলে, পরে দিমু। পরে কখন দিবেন বললে পিস্তল বেড় করে ধমক দেয়।

শিক্ষার্থীরা আরও বলেন, তমালকে গুলি করার আগে শিক্ষার্থীদের ওপর ক্ষুব্ধ হন শরীফ। তিনি শিক্ষার্থীদের বলে, তোমাদের কারও কি পোষা পাখি আছে? আমার পোষা পাখি আছে। এই বলে তিনি ব্যাগ থেকে পিস্তল বের করে আমাদের বলে, এটা আমার পোষা পাখি। এরপর গুলি করেন। গুলি শিক্ষার্থী আরাফাত আমীন তমালের ডান উরুতে লাগে। পরে সহপাঠীরা ৯৯৯ এ কল দিলে সদর থানা পুলিশ ও জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) ঘটনাস্থলে পৌঁছে রায়হান শরীফকে অস্ত্রসহ আটক করে।

রায়হান শরীফের এ ধরনের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে জানতে চাইলে শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ আমিরুল হোসেন চৌধুরী বলেন, সাধারণ শিক্ষার্থীরা লিখিত কিংবা মৌখিক কোনোভাবেই আমাকে আগে জানায়নি। তবে এই শিক্ষকের এ ধরনের কর্মকাণ্ডের কথা অন্য মাধ্যমে শুনেছিলাম। এ জন্য তাঁকে বদলির চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তাঁর বদলি হয়নি।

সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সিরাজুল ইসলাম বলেন, রায়হান শরীফের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে মঙ্গলবার বিকেলে সিরাজগঞ্জ অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে পাঠানো হয়। পরে বিচারক বিল্লাল হোসেন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করে তাকে কারাগারে পাঠিয়েন।

আটকের পর শফিকের কাছ থেকে সেভেন পয়েন্ট ফাইভ সিক্স বোরের দুটি বিদেশি পিস্তল, ৮১ টি গুলি, চারটি ম্যাগাজিন ও ১২টি বিদেশি চাকু জব্দ করা হয়। তবে রায়হান শরীফ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ায় রিমাণ্ড মঞ্জুর করা হয়নি।

নতুনসময়/এএম


শিক্ষার্থী গুলি, রহস্য, সিরাজগঞ্জ, পিস্তল, ভয়ভীতি, উত্ত্যক্ত