ঢাকা শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

সৌদি প্রবাসী জোছনার ২১২ নম্বর ছেলে


১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১৮:৫২

কমলাপুর স্টেশনের সেই ছেলেটির নাম ২১২ নম্বর,

শ্যামলা, মায়াময় চেহেরার ছেলেটির বয়স বারো বা তেরো।

ইস্, বিল গেটসের কথা মনে পড়ে গেল,

কোথায় থেকে কী।

ভাবতে ভাবতে পথ চলতে শুরু করলাম, তাও ২১২ নম্বরের পেছনে ছুটছি,

এই নামে ডাকতে বিবেক নাড়া দিচ্ছে।

এক সময় ওর পাশে বসে পড়লাম।

ম্লান হেঁসে বললাম, নামটা কি জানতে পারি?

পেছনে ঘুরে জার্সির নামটা দেখিয়ে দিল।

আমি বললাম, একটা নাম আপনার থাকতেই পারে।

আপনি ডাকতে শুনে ছেলেটি অট্টহাসিতে......

আমি মুখ ভার করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছি।

ছেলেটা বুঝতে পেরে, দুঃখিত আপু।

আসলে আমাদের কোনো নাম হয় না, কেউ তুমি বা আপনি বলে না।

আমার একটা অভ্যাস, সেই যেই হোক আপনি করে সম্বোধন করা।

মাঝেমধ্যে রিকশাচালকও অবাক হয়।

আমার কথা থাক...

আপু! নিজের অর্জন বলতে আমার কাছে এইটুকু ২১২ নম্বর এই নামটি। এই স্টেশনের সবাই চেনে।

পৃথিবী সত্যি বৈচিত্র্যময় আমাকে প্রায় ভাবিয়ে তুলে।

আপু! আমাদের ইচ্ছে, পূর্ণতা বলতে কিছু নেই।

আপনার শপিংয়ের প্যাকেটের বাইরে যে কাগজটা আছে নিশ্চয় অপ্রয়োজনীয়! যদি কিছু মনে না করেন আমাকে দিতে পারেন।

কিছু না বলে দিয়ে দিলাম।

সুন্দর একটা উড়োজাহাজ বানিয়ে আকাশে ছুঁড়ে দিল। আপু, আমাদের স্বপ্ন এতটুকু।

ওই যে হাতে থালা নিয়ে বুড়ো খালা যাচ্ছে তার চাহিদা কী জানেন?

এক মুঠো ভাত, আর কাঁচামরিচ হলেই দিনটা চলে যায় পরম তৃপ্তিতে।

আমাদের আবার তৃপ্তি কিসে?

আমাদের সন্তুষ্টি কোথায়?

আমরা দেখি বিল গেটস কে, তার সফলতায় খুশিতে খুশি হয়।

আর যখন দেখি আমাদের মতো বয়সের ছেলেরা মাদকে আসক্ত হয়ে ফুটপাতে পড়ে থাকে।

অন্তত ভাগ্যে বিল গেটস কে এই অপরাধ থেকে দূরে রেখেছে।

আমি চমকে উঠলাম, অসাধারণ কথাগুলো শুনে খুব বেশি জানতে ইচ্ছে হচ্ছিল পড়ালেখা কত দূর করেছে।

ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও করি না।

জানো আপু! একদিন আমার জুতাগুলো মসজিদ থেকে কেউ একজন নিয়ে গেছে। কাউকে দুঃখের কথা বলতে পারি না, এক পাশে গিয়ে খুব কাঁদলাম।

চিন্তা করে দেখলাম আমাদের আশপাশের অনেকের পা নেই, ওদের তো জুতা পরাও হয় না, আমার পা আছে ভবিষ্যতে জুতা পরার সুযোগ তো আছে।

সত্যি ওর বড় মন মানসিকতা দেখে আমি অবাক হচ্ছি।

আমাদের মতো যারা আছে ক্ষুধার জ্বালায়, লালা ঝরে দুই টাকা কামাই করে ভাত পেটে দেয় না নেশা করে।

এই বিষ কারা ছড়িয়ে, ছিটিয়ে দিচ্ছে?

কুকুরের পাশে ঘুমে বিভোর শিশু দিন-রাত, সহস্র বছর কাটে আমাদের এভাবে।

ইট, পাথরের গড়া মানুষগুলোর ঘরে যখন আমরা উল্লাস দেখি, লালসা, কামনার কোষাগারে তৃপ্তির জায়গায় আঘাত হানে এক নিদারুণ ব্যথা।

আমি চোখ মুছতে লাগলাম।

আমি স্পষ্ট দেখতে পারছি ছেলেটির বুকের পাঁজরে গাঁথা চিরন্তন কষ্ট।

ফুটপাতে মানুষগুলো কুকুর জড়ায়ে যখন ঘুমে বিভোর, তখন আমি বিল গেটসকে সামনে নিয়ে আসি কল্পনায়।

হঠাৎ চিৎকার শুনি এই ২১২ নম্বর এদিকে আয়।

তখন স্বপ্ন ভেঙে যায়।

কেউ একজন ডাক দিল ২১২ নম্বর বলে।

আপু! আবার দেখা হতে পারে।

এই বলে ছেলেটি দৌড় দিল, আমি তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম আর ভাবতে লাগলাম।

ঝিমিয়ে গেছে আমাদের মানবতা, ওদের করুণ চাহনিতে ভিজাবে না আমাদের বিবেকসত্তা!

কেউ ছুঁয়ে দেখবে না ওদের চামড়ার ভাজে ভাজে কত ঘৃণা লুকায়িত।

চোখের মণিতে কিছু প্রশ্ন আর অসহায়ত্ব স্পষ্ট।

আমরা চেতনাহীন!

আমাদের বিবেকের চার দেয়ালে ঘুটঘুটে অন্ধকার।

আমার কখন জাগব, কি জানি!

ঘুমন্ত মহাশক্তির আড়ালে আমাদের বিবেক দণ্ডায়মান।

আর আমার কানে বারবার বাজতে লাগল, ছেলেটির বলা কথাটি বিল গেটস বেঁচে গেছে এই কুৎসিত, অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজ থেকে।

হাজার অপরাধ থেকে।